বিবাহ বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক কেন ফৌজদারি অপরাধ নয়?


শাকিল মাহমুদ (মিতুল) : সাম্প্রতিক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। এতে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ অর্থাৎ বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে পরে বিয়েতে অস্বীকার করাকে অপরাধের স্বীকৃতি দিয়ে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

এতে করে শাস্তি শুধুমাত্র পুরুষ সঙ্গী পাবে আর মহিলা সঙ্গীকে সম্পূর্ণ দায়ী মুক্তি দেয়া হয়। কোন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও নারী স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে বিবাহ বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক করলে সেটি কোন অপরাধ নয় একই সাথে শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারী সঙ্গী যদি পুরুষ সঙ্গীকে প্রলোভন দেখায় সে ক্ষেত্রে নারী সঙ্গীর কোন অপরাধ নেই! এই ধরনের শাস্তি সাংবিধান পরিপন্থী ও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর মূল্যবোধের পরিপন্থী।

বাংলা একাডেমির অভিধান অনুযায়ী ‘প্রলোভন’ শব্দের অর্থ অতিশয় লোভী, লালসা। সুতরাং লোভ দেখানো এবং লোভে পড়া দুজনই সমান অপরাধী।

আধুনিক সভ্যতার এই যুগে পশু-পাখির মত মানুষ বিবাহবহির্ভূত ব্যভিচার মত নিকৃষ্ট কাজ এই দেশের ফৌজদারি আইনে কোনো অপরাধ নয়। নিঃসন্দেহে এটি একটা সভ্য জাতির জন্যে লজ্জাকর। পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মে, সভ্যতায় ব্যভিচার ছিলো একটি ঘৃণিত পাপ, শাস্তিযোগ্য দণ্ডনীয় অপরাধ। ইসলাম, খৃষ্টান, ইহুদি ধর্মে ব্যভিচার শাস্তি “মৃত্যুদণ্ড” বিধান আছে। হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মেও ব্যভিচার নিন্দনীয় পাপ মনে করে।

বর্তমানে আমাদের সমাজে মহামারীর মত পরকিয়া, ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যভিচারের কারণে হত্যাসহ নানা নিষ্ঠুরতার বলি হচ্ছে সন্তান, স্ত্রী, স্বামীসহ আপনজন। এ ঘৃণ্য ঘটনা বিভিন্নমুখী বিশৃঙ্খলা, অশান্তি, কলহ-বিবাদের সূত্রপাত করে, এমনকি দাম্পত্য সম্পর্কের তিক্ততাপূর্ণ অবসান ঘটাচ্ছে।

আরও পড়ুন : ধর্ষণ মামলার বিচার ৩০ দিনের মধ্যে শেষ করা সম্ভব কি না?

দেশে ব্যভিচারের বিচারের জন্য দণ্ডববিধি ১৮৬০ এর ৪৯৭ ধারায় যে সংজ্ঞা, শাস্তি উল্লেখ্য আছে তা অসাংবিধানিক, অযৌক্তিক, এই ধারাও নারীদের ব্যভিচার করতে আরো বেশি প্রশ্রয় দিয়েছে। দণ্ডবিধি ধারা ৪৯৭ ধারায় বলা আছে,

যদি কোনও ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির স্ত্রী অথবা যাকে সে অপর কোনও লোকের স্ত্রী বলে জানে বা তার অনুরূপ বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে এমন কোনও নারীর সঙ্গে উক্ত নারীর স্বামীর সম্মতি বা সমর্থন ব্যতিরেকে এরূপ যৌন সম্পর্ক করে যা নারী ধর্ষণের শামিল নহে, সে ব্যক্তি ব্যভিচারের অপরাধে দোষী এবং যেকোনো বিবরণে কারাদণ্ডে যার মেয়াদ পাঁচ বছর পর্যন্ত হতে পারে অথবা অর্থ দণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। তবে ব্যভিচারে অংশগ্রহণকারী নারী দুষ্কর্মের সহায়তাকারিণী হিসেবে দণ্ডিত হবে না।

এই ধারায় যেসব অসঙ্গতি আছে তা নিয়ে একটু আলোচনা করি। সাধারণত, ব্যভিচার হয় নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মতিতে। কিন্তু এই ধারায় ব্যভিচারের জন্যে শুধুমাত্র পুরুষকে সাজা দেয়ার বিধান রয়েছে, ব্যাভিচারীনি স্ত্রীলোককে সাজা থেকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। এমনকি পুরুষটি যদি নারী দ্বারা প্ররোচিতও হয়ে থাকে তবুও শাস্তি কেবল পুরুষের! শুধুমাত্র ব্যাভিচারীনি স্ত্রীলোকের স্বামীকে পরপুরুষের বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার দেয়া হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী পরস্পর, পরস্পরের বিরুদ্ধে অথবা অন্য কোন ব্যক্তিকে ব্যভিচার মামলা দায়ের অধিকার দেয়া হয়নি।

অথচ বাংলাদেশ সংবিধান, তৃতীয় ভাগের (মৌলিক অধিকার) অনুচ্ছেদ ২৭ অনুযায়ী সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। অনুচ্ছেদ ২৮(১) এ বলা আছে,- কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবেন না।

অনুচ্ছেদ ৩১ অনুযায়ী আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার দেয়া হয়েছে। এছাড়া অনুচ্ছেদ ২৬ মতে সংবিধানের তৃতীয় ভাগের (মৌলিক অধিকার) বিধানাবলীর সহিত অসমঞ্জস সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হয়ে যাবে। সুতরাং দণ্ডবিধি এই ধারা এবং সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধারাটি সাংবিধানিকভাবেই বাতিলযোগ্য বা সংশোধনযোগ্য।

কোন স্ত্রীলোক তার স্বামীর সম্মতি নিয়ে পরপুরুষের সাথে যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হলে তা ব্যভিচার হবে না। এই বিধান প্রকারান্তর স্ত্রীকে দিয়ে পতিতাবৃত্তি করানোর সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮(১) -এ বলা আছে গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সুতরাং দণ্ডবিধি এই ধারা সাংবিধানিকভাবেই বাতিলযোগ্য বা সংশোধনযোগ্য।

আরও পড়ুন : অপরাধীরও আইনানুগভাবে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে

দণ্ডববিধির ৪৯৭ ধারার বিধান পর্যালোচনায় স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, অবিবাহিত নারীর সঙ্গে, বিধবার সঙ্গে, অথবা স্বামীর সম্মতিপ্রাপ্ত স্ত্রীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক ব্যভিচারের আওতায় পড়বে না। এটি আমাদের দেশের মানুষের মূল্যবোধ, ধর্ম ও প্রচলিত প্রথার পরিপন্থী। এই দেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মীয় নৈতিকতা দৃষ্টিকোণ থেকে অবৈধ যৌনাচারকে নিকৃষ্ট পাপ মনে করে। এইসব কারণেও এই দুইটি ধারা সংশোধনযোগ্য।

এই ধারায় স্বামীর সম্মতিতে স্ত্রীর পরপুরুষের সাথে যৌন সংসর্গের বৈধ বিধান থাকায় নারীর মর্যাদা ও স্বাধীন সত্তার প্রতি অবমাননা করা হয়েছে। এখানে স্বামীর সম্মতিতে কোনও একটি অপরাধমূলক কাজ অপরাধ হওয়া, না হওয়া গুরুতর আইনের প্রশ্ন এসে যায়। স্ত্রী, স্বামীর সম্মতির নিয়ে অন্য ব্যক্তিকে আঘাতের হুমকি দিলে বা আঘাত করলে, সামান্য দুইশত টাকার কোনো অস্থাবর সম্পদ চুরি করলে তা অপরাধ হয়, তাহলে ব্যভিচার মত নিন্দনীয় নিকৃষ্ট কাজ করলে তা কেনো অপরাধ হবে না?

কোন কাজ অপরাধ কিংবা অপরাধ নয় তা নির্ণয়ের অধিকার কেবল সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের। স্বামী সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ নয়।

বিবাহিতদের ক্ষেত্রে ব্যভিচার ফৌজদারি অপরাধের পাশাপাশি এটি দেওয়ানি অন্যায়। মুসলিম পার্সোনাল ল’ অনুসারে বিবাহ হচ্ছে একটা ‘দেওয়ানি চুক্তি’। স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের পরস্পর মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক করার বৈধ সিভিল রাইট। সে অধিকার আদায় না হলে স্বামী-স্ত্রীর যে কেউই পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫ এর অধীনে ‘দাম্পত্যজীবন পুনরুদ্ধার’ -এর জন্য মোকদ্দমা দায়ের করে প্রতিকার চাইতে পারেন।

স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্কের মাঝে তৃতীয় পক্ষ শারীরিক সম্পর্ক করলে, তিনি ওই বৈধ সম্পর্কের মাঝে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বা অধিকার ভঙ্গকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন। ফলে চুক্তি, অধিকার ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করা যাবে।

সুতারাং দেশের মধ্যে সেক্সুয়ালি অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিবাহবহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক কি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে একই সাথে সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের অত্র ধারায় নারী-পুরুষ উভয়কে শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং দণ্ডবিধি ৪৯৭ ধারা সংশোধন করর ব্যভিচার শাস্তিও আরো বৃদ্ধি করতে হবে। আশা করি স্বাধীন বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিদের সেক্সচুয়াল অপরাধ ও ব্যভিচার প্রতিরোধের জন্যে আইন সংশোধন করতে শুভ বুদ্ধির উদয় হবে।

লেখক : অ্যাডভোকেট; জজ কোর্ট, নোয়াখালী।



Source link

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *