১৭ বছরে বিচারাধীন মামলা বেড়েছে ২৭ লাখ


১৯৯৯ সালে সর্বোচ্চ আদালত বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার রায় দেন। সেই সঙ্গে দেন ১২ দফা নির্দেশনা। কিন্তু নানা কারণে কার্যকর হয়নি উচ্চ আদালতের আদেশ। পরে ২০০৭ সালে ১ নভেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথককরণের ঘোষণা আসে।

তবে ১৭ বছর পার হলেও রাষ্ট্র পরিচালনার অপরিহার্য ও অতি গুরুত্বপূর্ণ এ অঙ্গটি এখনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। গত আগস্টের শুরুতে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর অন্তর্বর্তী সরকার বিচার বিভাগ সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশন গঠন ও বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়কে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া প্রস্তাবনা আশান্বিত করছে আইন, বিচারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বিচারপ্রত্যাশীদের।

আইন ও বিচারসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিচার বিভাগে সুপ্রিম কোর্টের একক নিয়ন্ত্রণ না থাকার বিশৃঙ্খলায় মামলার জট বেড়েছে। বিচারক ও অবকাঠামো সংকটও দূর হয়নি। আধুনিকায়ন হয়নি বিচারব্যবস্থা। ১৭ বছরে অনিষ্পন্ন মামলা বেড়ে হয়েছে প্রায় তিনগুণ। ২০০৭ সালে যেখানে উচ্চ ও অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলা ছিল সাড়ে ১৫ লাখের কিছু বেশি। এখন তা ৪২ লাখের বেশি। অর্থাৎ দেড় দশকের কিছু বেশি সময়ে মামলা বেড়েছে ২৭ লাখ।

আইন ও বিচার বিশ্লেষকরা বরাবরই বলে আসছেন, মামলার জটের প্রধান কারণ নিষ্পত্তি যত হয়, তার চেয়ে বেশি মামলা আসে আদালতে। অন্যদিকে বিচার বিভাগে দ্বৈতশাসন চলে। ফলে সুপ্রিম কোর্ট তথা প্রধান বিচারপতি বিচারাঙ্গনের সর্বোচ্চ অভিভাবক হলেও নানা বিষয় কার্যকরণে কার্যত বিচার বিভাগকে তাকিয়ে থাকতে হয় সরকারের দিকে। এ কারণে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আদালতে। বিচার বিলম্বের কারণে আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক ভোগান্তিতে পড়েন বিচারপ্রত্যাশীরা।

কতটুকু বাস্তবায়ন হলো মাসদার হোসেন মামলার রায়

অধস্তন আদালতের বিচারকদের বেতন গ্রেড একধাপ নামিয়ে আনার জেরে ১৯৯৫ সালে একটি রিট মামলা হয় হাইকোর্টে। মামলায় বিচারকদের প্রশাসনের ক্যাডারভুক্ত (বিসিএস) করার বৈধতাকেও চ্যালেঞ্জ করেন বিচারক মাসদার হোসেনসহ অন্য বিচারকরা। এ নিয়ে হাইকোর্টের রুলের পর ১৯৯৭ সালের ৭ মে হাইকোর্টের রায়ে রুল মঞ্জুর হয় এবং জুডিসিয়াল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র সার্ভিস করার আদেশ দেওয়া হয়।

এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করলে ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ আদালত জুডিসিয়াল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র সার্ভিস ঘোষণা করার ঐতিহাসিক রায় দেয়। আর বিচার বিভাগের মর্যাদা ও স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা রক্ষায় ১২ দফা নির্দেশনা দেয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনাটি হলো বিচার বিভাগকে জাতীয় সংসদ এবং প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখতে হবে।

২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর আইন মন্ত্রণালয় তা প্রকাশ করে হলফনামা আকারে পরের বছর ৩ জানুয়ারি আপিল বিভাগে দাখিল করে। তবে বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধির এ গেজেট নিয়ে সংশ্লিষ্ট মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবীদের দ্বিমত ছিল। ওই দ্বিমত-আপত্তি এখনো আছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিচার বিভাগকে সরকার তথা আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের মুখাপেক্ষী হতে হয়।

মাসদার হোসেন মামলার সময় বিচারকদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধার কিছুটা পরিবর্তন হলেও আইন ও বিচারসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশে বিচারকদের মর্যাদা ও সুবিধাদি আন্তর্জাতিকমানের নয়। জেলা ও দায়রা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ বাদে নিম্নপদস্থ বিচারকদের আবাসন, নিরাপত্তা, গাড়ি সুবিধা, দপ্তরে লোকবল নেই। একরকম বৈষম্যের মধ্যে মামলা-জটের চাপ নিয়েই বিচারকাজ করতে হয়।

মাসদার হোসেন মামলার বাদী অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মাসদার হোসেন মনে করেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী রিভিউ আবেদনের মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতে আপিল বিভাগের ৮ নম্বর নির্দেশনার (মাসদার হোসেন মামলা) একটি অংশ কার্যকর হয়ে গেছে। এখন অন্য নির্দেশনাটি (বিচার বিভাগকে প্রশাসনমুক্ত রাখা) কার্যকর হলেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হবে।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের এ সদস্য বলেন, ‘এখন তো আমরা রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নই। প্রশ্ন হচ্ছে, এ পরিস্থিতিতেও কি বিচার বিভাগ সেই তিমিরে থাকবে? এ প্রশ্নের মীমাংসা এখনই হওয়া উচিত।’

অন্যতম প্রতিবন্ধক ১১৬ অনুচ্ছেদ

সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়টি রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত রয়েছে। আদলতে এ কাজগুলো করে আইন মন্ত্রণালয়। রাষ্ট্রপতি তাতে শুধু অনুমোদন দেন। অর্থাৎ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হলেও ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণে সরকারের হস্তক্ষেপ থাকে। সংবিধানের এ বিধানটিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অন্যতম অন্তরায় বা প্রতিবন্ধক হিসেবে মনে করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বিচারসংশ্লিষ্টরা।

এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৭ অক্টোবর ১১৬ অনুচ্ছেদ কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দেন বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের নেতৃত্বে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। একই সঙ্গে হাইকোর্ট ২০১৭ সালে প্রণীত বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (ডিসিপ্লিনারি) রুলস নিয়েও প্রশ্ন তুলে রুল দেয় আদালত। এ ছাড়া বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় করতে রুলের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ কতটুকু প্রতিপালন হয়েছে, তা দুই মাসের মধ্যে জানতে চায় হাইকোর্ট।

এ রিটের পক্ষে শুনানি করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি বলেন, ১১৬ অনুচ্ছেদটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করে। রুলের জবাব এলে দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে বিচার বিভাগকে প্রকৃতভাবে স্বাধীন করার কাজ শুরু হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই এ বিষয়ে ফল আসবে বলে মনে করি।’

প্রত্যাশা বেড়েছে প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে

গত ২১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টে এক অনুষ্ঠানে অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে অভিভাষণ দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এদিন বিচার বিভাগের জন্য একটি রোডম্যাপ তুলে ধরে তিনি বলেন, বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় স্থাপনে শিগগির উদ্যোগ নেবে।

এরই ধারাবাহিকতায় সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনা করে গত ২৭ অক্টোবর পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনসংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

এতে বলা হয়, রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার পৃথককরণ কার্যকররূপে বাস্তবায়িত না হলে রাষ্ট্রে সংবিধানের সুসংহত চর্চা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সুম্মখীন হয়। সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তি দুর্বল হয়।

প্রস্তাবনায় মাসদার হোসেন মামলার রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ওই রায়ে ক্ষমতার পৃথককরণের যে রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে, তার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হলো দেশের বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা। প্রচলিত দ্বৈতশাসন কাঠামো তথা অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, শৃঙ্খলা প্রভৃতি বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের যে যৌথ এখতিয়ার রয়েছে, তা সম্পূর্ণ বিলোপ করে বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার তাগিদ আসে প্রস্তাবনায়।

এ বিষয়ে মাসদার হোসেন বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি একটি মহতি উদ্যোগ নিয়েছেন। এর ফলে আমাদের ৫৩ বছরের যে স্বপ্ন, সেটি পূরণ হবে বলে আশাবাদী।’

সূত্র: দেশ রূপান্তর



Source link

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *