সামাজিক মাধ্যমে ব্যারিস্টার বিতর্ক: প্রচার বনাম বাস্তবতা
ব্যারিস্টার নেওয়াজ মোরশেদ : বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা আলোচিত বিষয় কোন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি ব্যারিস্টার কিনা? এটা অবশ্য বাংলাদেশে নতুন কিছুই নয়, বাংলাদেশে একটি সস্তা ট্রেন্ড হচ্ছে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী বা বিরোধী কাউকে আসল ব্যারিস্টার বা আইনজীবী না বলে বিভিন্নভাবে আক্রমণ করা। পরিতাপের বিষয় হলো সাধারণ মানুষের সাথে সাথে অনেক নামি-দামি, বিখ্যাত-কুখ্যাত আইনজীবীরাও সেই তর্কে জড়াচ্ছেন এবং মনগড়া তথ্য দিয়ে স্রোতে গাঁ ভাসাচ্ছেন। একজন আইনজীবী হিসেবে আমি মনে করি সেটা কখনোই শোভনীয় ও গ্রহণযোগ্য নয়। তাই নাগরিক এবং আইনজীবী কমিউনিটির একজন ক্ষুদ্র সদস্য হিসেবে বিষয়টি পরিস্কার করার অভিপ্রায়ে লিখছি।
এ বিষয়ে বিস্তারিত বলার আগে আমি এতটুকু বলতে চাই, নিজে ব্যারিস্টার এবং ১০ বছরের অধিক বাংলাদেশী আইনজীবীদের ব্যারিস্টার হওয়ার প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত থাকায় কিছুটা হলেও আপনাদেরকে বলার মত যোগ্যতা রাখি বলে মনে করছি। আমার ক্ষেত্রেও এমন হয়েছিল। আমার এলাকার অনেকেই ব্যারিস্টার হতে লন্ডনে গিয়েছিলেন এবং মোটামুটি সবার সাথে আমার লন্ডনে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। দুঃখের বিষয় হলো আমি ছাড়া আমার এলাকার কেউ ব্যারিস্টার উপাধী অর্জন করতে পারেন নাই।
কিন্তু এলাকায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা ভিজিটিং কার্ডে অবলীলায় নিজেকে ব্যারিস্টার পরিচয়ও দিচ্ছেন এবং তারমধ্যে একজন আছেন যিনি আবার বলছেন আমি ব্যারিস্টার না এবং ইংল্যান্ডে ই-মেইলও করেছিলেন, যার উত্তর তিনি নিশ্চয়ই পেয়েছেন। তার কথা আমি আমলেই নেই না। তবে হালের আলোচিত বিষয়টি অন্যরকম। আমার মত গ্রামের বা এলাকার বিষয় নয়, বরং জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে।
ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস এ মোটা দাগে ২ ধরনের আইনজীবী আছেন, সলিসিটর এবং ব্যারিস্টার। অন্য আরো ২ শ্রেণীর আইনজীবী আছেন যারা CILEX এবং OISC দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তবে আজকের আলোচনা সলিসিটর এবং ব্যারিস্টার এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছি। সলিসিটরগণ ‘ল সোসাইটি’ এর পক্ষে ‘সলিসিটরস রেগুলেটরি অথরিটি’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং ব্যারিস্টারগণ ‘জেনারেল কাউন্সিল অব দ্যা বার’ বা ‘বার কাউন্সিল’ এর পক্ষে ‘বার স্ট্যান্ডার্ডস বোর্ড’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
সলিটিসরগণ সরাসরি বিচারপ্রার্থীদের সাথে কাজ করেন এবং আদালতে তাদের রিপ্রেজেন্ট করেন ব্যারিস্টারগণ। ব্যাতিক্রম হচ্ছে, সলিসিটর যারা Higher Rights of Audience পান তারাও আদালতে ক্লায়েন্টদের রিপ্রেজেন্ট করতে পারেন এবং ব্যারিস্টার যারা Public Access পান তারাও আবার সরাসরি ক্লায়েন্ট গ্রহন করতে পারেন। এসব বিষয়ে বিশদ আলোচনায় যাব না।
এখন আসি মূল আলোচনায় ব্যারিস্টার কারা এবং কিভাবে এই উপাধি অর্জন করা যায়। ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস এ ব্যারিস্টার হতে হলে প্রধানত দুইটি প্রক্রিয়া শেষ করতে হয়, একাডেমিক এবং ভোকেশনাল। একাডেমিক অর্থ ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস এর কোন স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের উপর স্নাতক বা অন্য বিষয়ে স্নাতকোত্তর একটি কনভার্সন কোর্স (GDL) অর্জনের পর ৯ মাসের একটি ইন্টেনসিভ ভোকেশনাল কোর্স করতে হয়। কালের পরিক্রমায় এই কোর্সটির এখন নাম ‘বার ট্রেনিং কোর্স’। আমি যখন কোর্সটি সম্পন্ন করি তখন ছিল ‘বার প্রফেশনাল ট্রেনিং কোর্স’। কোর্সটির প্রভাইডার বর্তমানে মাত্র ১০ টি প্রতিষ্ঠান যাদেরকে Authorised Education and Training Organisations (AETO) বলা হয়। আর একটি প্রক্রিয়া হলো Bar Transfer Test (BTT)। কয়েক শ্রেণীর প্রফেশনাল বার স্ট্যান্ডার্ডস বোর্ড বরাবর নির্ধারিত ফি প্রদান করে একাডেমিক এবং ভোকেশনাল স্টেজ এর অব্যহতি চাইতে পারেন, তাঁরা হলেন সলিসিটর, আইনের শিক্ষক, ইউরোপিয়ান আইনজীবী এবং কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশের আইনজীবী। ভোকেশনাল কোর্সের পরের প্রক্রিয়া হলো ‘Called to the Bar’।
ইংল্যান্ডে মাত্র ৪ টি ইন আছে, লিংকনস্ ইন, গ্রেস ইন, ইনার টেম্পল এবং মিডল টেম্পল। এই চারটি ইনের যে কোন একটি থেকে কল নেয়া যায়। ইনের কিছু ফরমালিটিস (Qualifying Sessions) সম্পন্ন করে একজন ‘কলড টু দ্যা বার’ এর জন্য যোগ্যতা অর্জন করেন অর্থাৎ ব্যারিস্টার উপাধি অর্জন করেন। কেউ যদি এর পর ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস এ ব্যারিস্টার হিসেবে প্রাকটিস করতে চান, তাহলে আরেকটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়, সেটা হলো Pupilage, অর্থাৎ যে কোন চেম্বারে ১২ মাসের প্রাকটিকাল ট্রেনিং, যার ৬ মাস নন প্রাকটিসিং আর ৬ মাস প্রাকটিসিং। তারপর তিনি বার কাউন্সিল থেকে প্রাকটিসিং সার্টিফিকেট নিতে পারেন এবং যে কোন চেম্বারে জয়েন করতে পারেন বা ৩ বছরের অধিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কাউকে চেম্বারে পার্টনার হিসেবে রেখে নিজেই চেম্বার দিতে পারেন।
তাহলে ব্যারিস্টার কারা? বার কাউন্সিলের বা বার স্ট্যান্ডার্ডস বোর্ড এর সংজ্ঞা অনুযায়ী তিন ধরনের ব্যারিস্টার রয়েছে, ১। প্রাকটিসিং ব্যারিস্টার (যাদের প্রাকটিসিং সার্টিফিকেট আছে); ২। নন-প্রাকটিসিং (unregistered) এবং ৩। Pupil (যারা স্বীকৃত কোন চেম্বারে ১২ মাসের প্রাকটিকাল ট্রেনিংরত)। এই হিসেবে আমরা যারা বাংলাদেশে চলে আসি বা যারা ইংল্যান্ডে থেকে যান কিন্তু পিউপিলেজ করেন না বা প্রাকটিসিং সার্টিফিকেট নেন না তাঁরা আনরেজিস্টার্ড ব্যারিস্টার। এখানে একটা বিষয় আরো পরিষ্কার করা দরকার, তাহলে আমরা যারা বাংলাদেশে আইনপেশায় জড়িত তারা নামের আগে কেন ব্যারিস্টার লিখি, কেন আনরেজিস্টার্ড ব্যারিস্টার লিখি না। এর ব্যাখ্যা হলো ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস এ যারা নিজেদের আইন পেশার সাথে জড়িত রেখেছেন (তবে তারা কোনভাবেই রিজার্ভড লিগ্যাল এক্টিভিটিস করতে পারবেন না), তাদেরকেই শুধু আইন বিষয়ক সার্ভিস প্রদানের সময় আনরেজিস্টার্ড বলতে হবে যেন তাদের ক্লায়েন্টরা কনফিউজড না হন প্রাকটিসিং এর বিষয় নিয়ে, কিন্তু অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে, মিডিয়ায়, সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, ভিজিটিং কার্ডে বা পাবলিকলি ব্যারিস্টার বলা যাবে। এক্ষেত্রে বার স্ট্যান্ডার্ডস বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত ‘Unregistered Barristers Guidance’ অনুসরণীয়।
আর একটি বিষয় পরিষ্কার করা বাঞ্চনীয়, পিউপিলেজ পাওয়া বা করা কতটুকু কষ্টকর। বার স্ট্যান্ডার্ডস বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য মতে ২০২৩-২০২৪ সেশনে ৬৭১ টি পিউপিলেজ এর জন্য মোট আবেদনকারী ছিল ৩৪০৮ জন এবং এই আবেদনকারীর বেশীরভাগই বৃটিশ। তাহলে একটু চিন্তা করুন সেটা কতটুকু প্রতিযোগীতামূলক। তবে অন্যান্যদেশীরা যে আবেদন করেন না বা পিউপিলেজ পান না সেটা সঠিক নয়। আমাদের অনেক বাংলাদেশীরা সেখানে প্রাকটিসিং ব্যারিস্টার এবং কয়েকজন আবার King’s Counsel (KC) যেটি আগে QC নামে পরিচিত ছিল। তবে অন্যান্য জটিলতার মধ্যে ভিসা জটিলতার কারণে অনেক বাংলাদেশী পিউপিলেজ এর জন্য আবেদন করেন না, তবে সেটারও অনেক রকম সমাধান রয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশীরা পিউপিলেজ এর জন্য আবেদন করতে পারেন না, এটি সঠিক নয়।
এবার আসি, কেউ ব্যারিস্টার কি না, কিভাবে যাচাই করবেন, প্রথমত তার নামের সঠিক বানান জেনে দি টাইমস পত্রিকায় সার্চ করা যেতে পারে অথবা বার স্ট্যান্ডার্ডস বোর্ড বা সংশ্লিষ্ট ইন এ যোগাযোগ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে দি টাইমস পত্রিকায় সার্চ করাকে আমি সবচেয়ে দ্রুত ও কার্যকারী পদক্ষেপ মনে করি, কেননা প্রত্যেক টার্মের কলড টু দ্যা বারে যে যে ব্যারিস্টার কল নেন তাদের নাম প্রকাশিত হয় দি টাইমস পত্রিকায়। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ই-মেইল এর স্ক্রিন শট দিয়ে প্রপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছে, সেটা স্পষ্টই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ, কারন সেখানে নামের বানান সম্পূর্ণ ভুল। আমি সঠিক নাম দিয়ে টি টাইমস পত্রিকায় সার্চ করেছিলাম এবং ২০০৮ সালের ট্রিনিটি টার্ম এ তাঁর কল নেয়ার সংবাদ ছাপা হয়েছিল ১০ অক্টোরব ২০০৮ তারিখে।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।
Leave a Reply