সংবিধান, কার্যপ্রণালিবিধি এবং বিল বা আইনের খসড়ার অপরিহার্য আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য
ফিরোজ উদ্দিন : সংসদে পাশের উদ্দেশ্যে আনীতসরকারি ও বেসরকারি বিলের উত্থাপন ও পাশের ধরন আলাদা এবং যা সংবিধান, কার্যপ্রণালিবিধি ও সংসদের নিজস্ব রেওয়াজ বা প্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রি তহয়। বাংলা অভিধানে ‘বিল (Bill)’ শব্দটির সমার্থক দ্বিতীয় শব্দ নেই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ও কার্যপ্রণালিবিধিতে বাংলায় ‘বিল (Bill)’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৮০ ও তৎপরবর্তী অনুচ্ছেদ এবং কার্যপ্রণালীবিধিতে ‘বিল (Bill)’ শব্দটির ব্যবহারে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।
সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদএর ২ দফার (ক) উপদফা ও কার্যপ্রণালিবিধির ২৪৬ অনুচ্ছেদে যথাক্রমে ‘খসড়া বিল (Draft Bill)’ ও ‘আইনগত প্রস্তাব (Legislative Proposal)’ শব্দ দুইটি ব্যবহৃত হয়েছে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে ‘খসড়া বিল (Draft Bill)’ ও ‘আইনগত প্রস্তাব (Legislative Proposal)’ সমার্থক মনে হলেও শব্দ দুইটির লেজিসলেটিভ অভিব্যক্তি এক নয়। ‘খসড়া বিল (Draft Bill)’ মূলত ‘আইনগত প্রস্তাব (Legislative Proposal)’ এর পূর্ববর্তী পর্যায় বা ধারণা।
‘খসড়া বিল (Draft Bill)’ বলতে সাধারণত এমন একটি প্রস্তাবকে বুঝায় যে প্রস্তাবটি সংসদে উত্থাপনের জন্য কার্যপ্রণালিবিধির সকল আনুষ্ঠানিকতা পরিপালন পূর্বক সংসদ সচিবালয়ে প্রেরণ করা হয়নি। এই পর্যায়ে যদি ‘খসড়া বিল (Draft Bill)’ টি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কোন সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয় এবং কমিটির মতানুসারে নূতন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে তাহলেও আইনত প্রস্তাবটিকে ‘খসড়া বিল(Draft Bill)’ হিসাবে আখ্যায়িত করাই যথার্থ।
আরও পড়ুন : আদালতে ডিজিটাল সাক্ষ্য: তত্ত্ব ও ব্যবহারবিধি (পর্ব-১)
অপরদিকে ‘আইনগত প্রস্তাব (Legislative Proposal)’ হলো ‘খসড়া বিল (Draft Bill)’ এর পরবর্তী পর্যায় অর্থাৎ ‘খসড়া বিল (Draft Bill)’ সংসদে উত্থাপনের জন্য উপযুক্ত হলেই কেবল সেটি ‘আইনগত প্রস্তাব (Legislative Proposal)’ বলা যায়। সংসদে উত্থাপনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে সংসদ সচিবকে নোটিশসহ প্রেরিত ‘আইনগত প্রস্তাব (Legislative Proposal)’ টি সংবিধান ও কার্যপ্রণালিবিধি অনুসারে ‘বিল (Bill)’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
সংবিধানের ৮০, ৮১ ও ৮২ অনুচ্ছেদে ‘বিল (Bill)’ ও ‘অর্থবিল (Money Bill)’ শব্দ দুইটি উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কার্যপ্রণালিবিধি অনুসারে ‘বিল (Bill)’ কে দুইভাবে ভাগ করা যায়, যথা:- (১) বেসরকারি বিল [বিধি-৭২] ও (২) সরকারি বিল [বিধি-৭৫]। বেসরকারি বিল বলতে মন্ত্রী ব্যতীত যেকোন সংসদ সদস্য কর্তৃক সংসদে উত্থাপনের উদ্দেশ্যে আনীত ‘আইনগত প্রস্তাব (Legislative Proposal)’কে বুঝায়। আবার সরকারি বিল অর্থ যেকোন সংসদ সদস্য ব্যতীত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী কর্তৃক আনীত ‘আইনগত প্রস্তাব (Legislative Proposal)’ কে বুঝায়।
তবে সংবিধান বা কার্যপ্রণালিবিধি অথবা অন্য কোথাও ‘বিল (Bill)’ এর আকার সম্পর্কে কোনকিছু সুনিদিষ্ট করা হয়নি। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদসহ পৃথিবীর সকল দেশের আইনসভায় বিলের আকার বা আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য প্রায় একই রকম। প্রত্যেক বিলের অন্যূন পাঁচটি অপরিহার্য আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যথাঃ- (১) শিরোনাম; (২) প্রস্তাবনা; (৩) সংক্ষিপ্তশিরোনাম; (৪) দফা ও (৫) উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতি।
(১) শিরোনাম (Long Title)
প্রত্যেক বিলের একটি সুনির্দিষ্ট শিরোনাম থাকে। ইংরেজীতে উক্ত শিরোনাম ‘Long Title’ নামে পরিচিত। ‘শিরোনাম’ বিলের উপরে লম্বা বাক্যে লেখা হয় বলে ‘শিরোনাম’কে ইংরেজীতে ‘Long Title’ নামে ডাকা হয়,যেমন:- “ঔষধ ও কসমেটিকস্ এর উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি, বিক্রয়, মজুদ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন, বিতরণ ও মাননিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে Drugs Act,1940 এবং Drugs (Control) Ordinance,1982 রহিতক্রমে যুগোপযোগী করিয়া নূতন আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে আনীত” শিরোনামটি।
‘বিল (Bill)’ সংসদে গৃহীত হওয়া ও মহামান্য রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভের পর বিলের শিরোনামের ‘আনীত আইন’ শব্দগুলির পরিববর্তে ‘প্রণীত আইন’ শব্দগুলি প্রতিস্থাপিত হয়। এভাবে বিলের শিরোনাম পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘Act’ এর শিরোনামে রূপান্তরিত হয়। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি ‘বিল (Bill)’ এমনভাবে রচিত হয় যাতে করে সংসদে কোন প্রকার সংশোধনী ছাড়া গৃহীত হলেও উক্ত বিলের শিরোনামে ‘আনীত আইন’ শব্দগুলির পরিবর্তে অন্যকোন পরিবর্তন প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পড়েনা।
(২) প্রস্তাবনা (Preamble)
বিলের প্রস্তাবনায় আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজন বর্ণনা করা হয়ে থাকে। ইংরেজী শব্দ ‘Preamble’ ও Enacting Formula কে কার্যপ্রণালিবিধিতে ‘প্রস্তাবনা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সব বিলের ‘Preamble’ না থাকলেও ‘Enacting Formula’ থাকে। আমাদের সংসদের প্রত্যকটি বিলের প্রস্তাবনার অংশকে এই দুইটি অংশে লিপিবদ্ধ করা হয়।
(৩) সংক্ষিপ্ত শিরোনাম (Short Title)
প্রত্যেক বিলের প্রস্তাবিত আইনের একটি ‘সংক্ষিপ্ত শিরোনাম’ বা ‘Short Title’ থাকে। বিলের প্রথম দফায় ‘সংক্ষিপ্ত শিরোনাম’ বা ‘Short Title’ সন্নিবেশিত থাকে। বিলের ‘শিরোনাম’ বা ‘Long Title’ হতে ‘সংক্ষিপ্ত শিরোনাম’ বা ‘Short Title’হতে ভিন্ন, যেমন:- ‘শিরোনাম’ বা ‘Long Title’ এর ‘সংক্ষিপ্ত শিরোনাম’ বা ‘Short Title’ “ঔষধ ও কসমেটিকস আইন, ২০২৩”। সংসদে গৃহীত হওয়া ও মহামান্য রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভের পর বিলের ‘সংক্ষিপ্ত’ বা ‘Short Title’ এর নামে আইনটি পরিচিত হয় বা আইনকে ডাকা হয়।
(৪) দফা (Clause)
প্রতিটি ‘বিল (Bill)’ একাধিক দফা দ্বারা সন্নিবেশিত হয়। প্রত্যকটি দফায় স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধান ও একটি ক্রমিক নম্বর থাকে। ক্রমিক নম্বরের পরে দফার একটি ‘Marginal Heading’ বা ‘উপ-শিরোনাম’ দেওয়া হয়। কোন কোন ‘দফা’ উপ-দফায় বিভক্ত হতে পারে। ‘উপ-দফা’ আবার ‘প্যারা’ এবং প্যারাসমূহ ‘সাব-প্যারা’ তে বিভিক্ত হয়। দীর্ঘ ও জটিল ‘বিল (Bill)’ এক বা একাধিক দফার সমন্বয়ে কয়েকটি খন্ডে বিভক্ত হতে পারে এবং প্রত্যকটি খন্ডে একটি করে শিরোনাম থাকে।
(৫) উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতি (Statement of Purpose and Reasons)
প্রত্যেক বিলের শেষের অংশে ‘উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতি’ বা ‘Statement of Purpose and Reasons’ সন্নিবেশিত থাকে। বিবৃতি বিলের অপরিহার্য উপাদান হলেও অপরিহার্য অংশ নয়। বিলের অন্তর্গত বিভিন্ন বিধানের ব্যাখ্যা বিবৃতিতে সন্নিবেশিত হয়। সাধারণত বিবৃতি বিলের অংশ নয় বলে সংসদে ‘বিল(Bill)’ বিবেচনার যেকোন পর্যায়ে এই অংশটির সংশোধনের সুযোগ বা প্রয়োজন নেই।
কিন্তু আমাদের সংসদের রেওয়াজ হলে- “বিল সংশ্লিষ্ট কোন কমিটিতে প্রেরিত হলে উক্ত কমিটি এই অংশটি সংশোধন করতে পারে। তবে বিল সম্পর্কিত কমিটি রিপোর্ট সংসদে পেশ করার পর সংশোধনের কোন সুযোগ থাকে না। আবার কোন বিল সংসদে উত্থাপনের সময় ভারপ্রাপ্ত সদস্য স্পীকারের অনুমতি সাপেক্ষে বিবৃতি পরিবর্তন করতে পারে।” বিবৃতিতে উল্লেখিত কোন কিছুই বিলের কোন অংশ সংশোধনের ক্ষেত্রে সংসদের ক্ষমতাকে সীমিত করেনা। বিল পাশ হলে এই অংশটি প্রকাশিত আইনের গেজেটে হতে বাদ পরে।
প্রত্যকটি বিলে উপরোক্ত অপরিহার্য আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য ছাড়াও বিলের বৈচিত্রের ভিত্তিতে অন্যান্য আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এই অন্যান্য আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগুলো বিলের প্রায়োগিক কার্যকারিতা বৃদ্ধি ও অস্পষ্টতা দূর করে বিধায় অন্যান্য আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে পরিহারের সুযোগ নেই।
লেখক: ফিরোজ উদ্দিন; লেজিসলেটিভ এ্যাসিস্ট্যান্ট, আইন প্রণয়ন শাখা-১ ও লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং ইউনিট (অতিরিক্ত দায়িত্ব), জাতীয় সংসদ সচিবালয়। ই-মেইল: [email protected]
Leave a Reply