শ্রমিকের মজুরি ৩ বছর পরপর পুনর্নির্ধারণ ও নির্ধারিত সময়ে মজুরি না দিলে ক্ষতিপূরণের সুপারিশ


বিভিন্ন খাতের শ্রমিকের মজুরি তিন বছর পরপর মূল্যায়ন ও পুনর্নির্ধারণের সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। এ ছাড়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মজুরি না দিলে শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ, মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের জন্য আপৎকালীন তহবিল, ট্রেড ইউনিয়ন করার শর্ত শিথিল, স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ, নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস, স্থায়ী শ্রম কমিশন প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন সুপারিশ করেছে কমিশন।

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদের নেতৃত্বাধীন শ্রম সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া মর্যাদাপূর্ণ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে ‘তুই-তুমি’ সম্বোধন চর্চা বন্ধ করতে বলেছে কমিশন।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গত রোববার (২০ এপ্রিল) বেলা ১২টার দিকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেয় ১৮ সদস্যের শ্রম সংস্কার কমিশন। শ্রম জগতের রূপান্তর-রূপরেখা: শ্রমিক অধিকার, সু-সমন্বিত শিল্প সম্পর্ক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন শীর্ষক প্রতিবেদনে মোটা দাগে ২৫টি সুপারিশ রয়েছে।

প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি জানায়। পরে বিকেলে শ্রম ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবেদনের বিষয়ে বিস্তারিত জানান কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদসহ অন্য সদস্যরা।

সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার উপ প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, চূড়ান্ত প্রতিবেদন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে কথা বলতে শ্রম সংস্কার কমিশনকে পরামর্শ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। যাতে করে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। কারণ, এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা রয়েছে।

সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতি নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক সব ক্ষেত্রে প্রত্যেক শ্রমিককে নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র বা প্রমাণপত্র দেওয়া বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে।

এ ছাড়া জাতীয় পেনশন স্কিমের অধীনে শ্রমিকবান্ধব পেনশন স্কিম চালু করার পাশাপাশি শিল্পাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকায় শ্রমিকদের জন্য কার্ডভিত্তিক রেশন দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

শ্রমিক ও তাঁর পরিবারের মর্যাদাকর জীবনযাপন নিশ্চিত করতে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করার সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। বলা হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক, সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে নিয়োজিত সব শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ ন্যূনতম মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবে।

কোনো খাতের মজুরি কাঠামো নির্ধারণে পরিবারে একক উপার্জনকারী হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে এমন পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে, যাতে শ্রমিক তাঁর পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে পারেন।

তৈরি পোশাক, ট্যানারিসহ ৪২ খাতের মজুরি কাঠামো এখন পাঁচ বছর পরপর নির্ধারণ হয়। এটি তিন বছর পরপর মূল্যায়ন ও পুনর্নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে। বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট গড় মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করার কথাও বলেছে কমিশন।

এখন বছরে ৫ শতাংশ হারে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি হয়। যদিও উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন কারণে চলতি বছর তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি হয় ৯ শতাংশ।

প্রায়ই দেখা যায়, মজুরি ও ক্ষতিপূরণ না পেয়ে আন্দোলনে নামেন শ্রমিকেরা। সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের মতো ঘটনা ঘটে। শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহি ও দায়বদ্ধ করতে একাধিক সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন।

বলা হয়েছে, মজুরি পরিশোধ-সংক্রান্ত তথ্য প্রতি মাসে অনলাইনে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে (ডিআইএফই) জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে মজুরি না দিলে দশমিক ৫ শতাংশ হারে শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য সরকারকে একটি আপত্কালীন তহবিল গঠনের সুপারিশ করেছে কমিশন। সেই তহবিলে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের দুই মাসের সমপরিমাণ মজুরি জমা রাখবে। তহবিলটি নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান, সরকার ও সংশ্লিষ্ট শিল্পের মালিকদের সংগঠনের যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে।

সরকারি দপ্তর ও সংস্থাগুলোতে স্থায়ী কাজের জন্য ‘আউটসোর্সিং’ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে বলেছে কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যাঁরা ইতিমধ্যে স্থায়ী ধরনের কাজে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিযুক্ত আছেন, তাঁদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী কর্মচারী হিসেবে নিয়োগের পদক্ষেপ নিতে হবে।

কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এটি অপ্রতুল উল্লেখ করে কমিশন ক্ষতিপূরণের হার বৃদ্ধি করে সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে।

কমিশন বলেছে, একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কনভেনশন ১২১ ও হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের মানদণ্ড নির্ধারণ করতে হবে।

এ ছাড়া সব খাতের শ্রমিকের জন্য দুর্ঘটনা বিমা বাধ্যতামূলক করা এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় আইন সংস্কার করতে হবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদকে প্রধান করে গত নভেম্বরে শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।

কমিশনের সদস্যরা হলেন সাবেক সচিব মাহফুজুল হক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের অধ্যাপক জাকির হোসেন, শ্রমিকনেতা তপন দত্ত, এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি ম. কামরান টি রহমান, গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার প্রমুখ।

ট্রেড ইউনিয়নের শর্ত শিথিল

শিল্প খাতে ট্রেড ইউনিয়ন করার বিধিনিষেধ শিথিল করা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দেশি-বিদেশি চাপ রয়েছে। বর্তমানে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে কোনো কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা ৩ হাজারের কম হলে ২০ শতাংশের সই লাগে।

৩ হাজারের বেশি হলে ১৫ শতাংশ শ্রমিকের সই লাগে। এই বিধিনিষেধ ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে সবচেয়ে বড় বাধা মনে করে সংস্কার কমিশন।

ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে প্রতিষ্ঠানের মোট শ্রমিকের অনুপাতের শর্তের পরিবর্তে ন্যূনতম শ্রমিক সংখ্যা বিবেচনা করার ওপর জোর দিয়েছে কমিশন। এ জন্য সুপারিশ প্রণয়নে একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটি করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া ট্রেড নিবন্ধনে স্বচ্ছতা আনতে কমিশন বলেছে, শ্রম অধিদপ্তরকে ৫৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সময়মতো সিদ্ধান্ত না নিলে শ্রম অধিদপ্তরকেও জবাবদিহি করতে হবে।

মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস

নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ১১২ দিন থেকে বাড়িয়ে ১৮০ দিন করার সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারকে সহায়তা দিতে হবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য বিশেষ স্কিম নেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়। পিতৃত্বকালীন ছুটির জন্য আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ছুটি নির্ধারণ করার কথাও বলেছে কমিশন।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যৌন হয়রানিসহ সব ধরনের হয়রানি ও সহিংসতা থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।

হাইকোর্টের ২০০৯ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী, সব কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতাবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। একই সঙ্গে অভিযোগ সেল ও নিষ্পত্তি কমিটি গঠন করা জরুরি।

মর্যাদাপূর্ণ শ্রমপরিবেশের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য লিঙ্গ, বর্ণ, জাতি ভেদে অবমানকর ও অমর্যাদাকর ভাষার ব্যবহার রোধ করার কথা বলেছে কমিশন। এ ছাড়া শ্রম আইনে মহিলা শব্দের পরিবর্তে নারী ব্যবহার, কর্মপরিবেশে তুই-তুমি সম্বোধন চর্চা বন্ধ, শ্রম আদালতের সব স্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনে জোর দেওয়া হয়েছে।

শ্রম প্রশাসন ব্যবস্থায় জবাবদিহি নিশ্চিত করতে স্থায়ী শ্রম কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে কমিশন। তার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি জাতীয় সামাজিক সংলাপ ফোরাম গঠনের উদ্যোগ দরকার।

এ ছাড়া জাতীয় নিম্নতম মজুরি কমিশন ও স্থায়ী জাতীয় মজুরি কমিশন গঠনের পাশাপাশি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে নতুন দুটি অধিদপ্তর সৃষ্টির সুপারিশ করেছে কমিশন।

সুপারিশ বাস্তবায়নে শুরুতে কী করা প্রয়োজন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, প্রথমেই তথ্যভান্ডারের কাজ শুরু করা যেতে পারে। এতে সব শ্রমিক পরিচয় থাকবে।

২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে শ্রম আইন সংশোধনে সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো প্রজ্ঞাপন দিয়ে করতে পারে। সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্যে পৌঁছাতে একটি শ্রম সম্মেলন করার ওপর জোর দেন তিনি।



Source link

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *