রিট পিটিশন এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষায় চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা


মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্: সংবিধান হলো একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন, যা রাষ্ট্রের কাঠামো, কার্যপ্রণালী, নাগরিকদের অধিকার এবং দায়িত্ব নির্ধারণ করে। এটি শুধুমাত্র একটি আইনি দলিল নয়, বরং এটি একটি জাতির আদর্শ, নীতি, লক্ষ্য ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এবং মৌলিক অধিকার হলো সংবিধানে স্বীকৃত নাগরিকদের সেই অধিকারসমূহ, যা তাদের স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে সংযোজিত হয়েছে। এবং নাগরিকদের এই মৌলিক অধিকারসমূহকে বলবৎ করার জন্য বিধান রাখা হয়েছে রিট পিটিশনের।

বাংলাদেশের সংবিধান এর আলোকে রিট পিটিশন হলো নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। সংবিধানের ৩য় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহকে নিশ্চিত করবার জন্য যে কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে দায়ের করতে পারে রিট পিটিশন। সংবিধানের ৪৪ নং অনুচ্ছেদে, সংবিধানের ৩য় ভাগ তথা মৌলিক অধিকারসমূহকে বাস্তবায়ন করবার জন্য হাইকোর্ট বিভাগে দেশের যেকোনো সংক্ষুব্ধ নাগরিককে মামলা রুজু করার অধিকার প্রদান করা হয়েছে।

আবার, জুডিশিয়াল রিভিউ বা রিট হলো নির্বাহী বিভাগ বা অন্য যেকোনো সরকারি বিধিবদ্ধ সংস্থার আইন বহির্ভূত সিদ্ধান্ত বা কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ করার অন্যতম একটি পন্থা। নির্বাহী বিভাগ তার ক্ষমতা প্রয়োগের ফলে যদি দেশের কোনো সাধারণ নাগরিকের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় তাহলে উক্ত ক্ষমতা ও ক্ষমতা প্রয়োগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জুডিশিয়াল রিভিউ চাওয়া যায় হাইকোর্ট বিভাগের কাছে। এটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকারের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করে। পাশাপাশি, এটি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণেও কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে।

সংবিধানের ১০২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি যিনি কোনো সরকারি বিধিবদ্ধ সংস্থার দ্বারা সংক্ষুব্ধ হয়েছেন, তিনি চাইলে উক্ত সংস্থার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রিট পিটিশন দায়ের করতে পারেন। তবে জনস্বার্থে দায়ের করা রিটের ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজে সংক্ষুব্ধ হবার বা ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকার প্রয়োজনীয়তা নেই। বরং, এক্ষেত্রে, কোনো ব্যক্তি যদি মনে করেন রাষ্ট্রের সচেতন নাগরিক হিসেবে সরকারি বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার কার্যক্রম সাধারণ নাগরিকের কোনো মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করছে, তাহলে সেই ব্যক্তি চাইলে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে রিট পিটিশন দায়ের করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, জনস্বার্থে দায়ের করা রিট পিটিশনের মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষা, শ্রমিকের অধিকার এবং নাগরিকদের মৌলিক সেবা নিশ্চিত করার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে।

তবে বর্তমানে রিট পিটিশনের কার্যকারিতা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বিচারিক বিলম্ব, প্রচলিত আইনি কাঠামোর সীমাবদ্ধতা, এবং সচেতনতার অভাব এই প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে। বেশিরভাগ রিট পিটিশনের ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায় নানান ধরনের আইনি জটিলতা। এর ফলে নাগরিকের মৌলিক অধিকার আদায়ে বিচারিক বিলম্বের বিষয়টি ত্বরান্বিত হয়ে থাকে। মামলার অতিরিক্ত চাপ, প্রক্রিয়াগত জটিলতা ও প্রশাসনিক দায়বদ্ধতাসহ ইত্যাদি বিষয়াবলি এই বিলম্বের পেছনে দায়ী। আবার সীমিত বিচারক সংখ্যা, সুবিচার প্রাপ্তিতে আর্থিক ব্যয় ও রাজনৈতিক প্রভাবসহ নানাবিধ কারণে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে থাকেন ন্যায়বিচার প্রার্থীরা। এছাড়াও, কিছু ক্ষেত্রে নাগরিকদের তাদের সাংবিধানিক অধিকার সম্পর্কে অসচেতনতাও এর পেছনে দায়ী। আইন সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব, শিক্ষার অভাব, আইনি পরামর্শের অভাবসহ নানাবিধ কারণে নাগরিকগণ তাদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন হয়ে পড়ে। এর ফলে, নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন, ন্যায্যবিচার প্রাপ্তিতে বৈষম্য ও রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা হ্রাস পায় এবং ক্ষমতার অপব্যবহার তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পায়।

এসকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, বিশেষ আদালত গঠন, বিচারকদের সংখ্যা বৃদ্ধিকরণ, ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে প্রক্রিয়া সহজীকরণসহ ইত্যাদি বিষয়াবলি বিবেচনায় আনা যেতে পারে। নাগরিকদের তাদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতনতা নির্বাহী বিভাগকে স্বেচ্ছাচারী করে তুলতে পারে। ফলে ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ, রিট পিটিশনের সাফল্যের উদাহরণ প্রচার, টোল-ফ্রি হেল্পলাইন চালুকরাসহ মিডিয়ার প্রচারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পাশাপাশি, রিট পিটিশনের প্রক্রিয়াটিকে ডিজিটালাইজ করার মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়াকে আরও সহজ, স্বচ্ছ এবং কার্যকর করা সম্ভব। ডিজিটাল প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নাগরিকদের জন্য ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ সুগম করতে পারে। এর ফলে যেমন সময়ের সাশ্রয় হবে তেমনিভাবে অনলাইন ফাইলিং এবং ভার্চুয়াল শুনানির সুযোগ তৈরি করার মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকেও আইনি ব্যবস্থায় যুক্ত করা যাবে। এটি শুধুমাত্র রিট পিটিশনের প্রক্রিয়াকে সহজ করবে না, বরং এটি বিচার ব্যবস্থায় জনগণের আস্থা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে।

পরিশেষে বলা যায়, রিট পিটিশন হলো সাধারণ নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার একটি অপরিহার্য উপকরণ। এর সুফল দেশের সর্বস্তরের জনগণের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য ডিজিটালাইজেশন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, এবং বিচারিক কাঠামোর উন্নয়ন অপরিহার্য। সঠিক উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে রিট পিটিশন নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। এটি শুধুমাত্র ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণেই নয়, বরং গণতন্ত্র এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

 লেখক: সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ল অ্যালায়েন্স, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্।



Source link

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *