মুসলিম আইনে হক শুফা বা অগ্রক্রয়


রেদওয়ান আহমেদ: কোন স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি শরীক বা প্রতিবেশী হওয়ার কারনে উক্ত সম্পত্তি সর্বাগ্রে ক্রয়ের অধিকারী হয় কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে দূরবর্তী কারো নিকট বিক্রয় করিলে উক্ত শরীক বা প্রতিবেশী অগ্রক্রয়ের অধিকার প্রয়োগ করিয়া উক্ত সম্পত্তি ক্রয় করিতে পারেন। মুসিলম আইনে উক্তরূপ ক্রয় অধিকার কে হক শুফা বা শুফার অধিকার বলে। শুফার অধিকার সম্পর্কে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) বলেন— যাহার জমি আছে এবং তিনি উহা বিক্রয়ের ইচ্ছা করিলে তাহার উচিত হইবে প্রথমে তাহার প্রতিবেশী কে জ্ঞাত করা।

১৯১৩ সালে পঞ্জাব হক সাফা আইন দ্বারা ভারতীয় উপমহাদেশে অগ্রক্রয়ের অধিকার সর্ব প্রথম মুসলিম আইনের মাধ্যমেই প্রয়োগ শুরু হয়। যা পরবর্তীতে ১৯২৮ সালে বঙ্গীয় প্রজা স্বত্ব আইন ১৮৮৫, সংশোধনের মাধ্যমে ২৬(চ) ধারা সংযোজন করত বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা জোতের সহ—শরীকদের অগ্রক্রয়ের অধিকার প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের অধিনে অগ্রক্রয়ের বিধান বিলুপ্ত করায়বর্তমানে মুসলিম আইনের পাশাপাশি কৃষি জমির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহন ও প্রজা স্বত্ব আইন ১৯৫০ এর ৯৬ ধারা ও অকৃষি জমির ক্ষেত্রে অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৪৯ এর ২৪ ধারা প্রয়োগ করে অগ্রক্রয়ের অধিকার দাবী করে মামলা করা যায়।

মুসলিম আইনে হক শুফা বা অগ্রক্রয়ের অধিকার কে দাবি করতে পারে?

মুসলিম আইনে নিম্নরূপ ৩ শ্রেনীর ব্যক্তি শুফার অধিকার দাবি করিতে পারে—

১। শাফী ই শরিক বা বিক্রিত ভূমির একজন সহ—শরীক।
২। শাফী ই খালিত বা বিক্রিত ভূমির মাধ্যমে পথ ব্যবহার বা পানি নিষ্কাশনের অধিকারী ব্যক্তি।
৩। শাফী ই জার বা বিক্রিত ভূমির সংলগ্ন ভূমির মালিক।

উপরোক্ত ৩ শ্রেনীর মধ্যে প্রথম শ্রেনী সর্ব প্রথম শুফার অধিকার দাবি করিতে পারিবেন এবং প্রথম শ্রেনী দাবী না করিলে দ্বিতীয় শ্রেনী শুফার অধিকার দাবি করিতে পারিবেন। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেনীর মধ্যে কেউ দাবি না করিলে তৃতীয় শ্রেনী শুফার অধিকার দাবি করিতে পারিবেন। তবে একি শ্রেনী ভুক্ত একাধিক ব্যক্তি দাবি করিলে প্রত্যেকেই সমান অংশ দাবি করিতে পারিবেন।শুফার অধিকার শুধুমাত্র বিক্রয় দলিলের ক্ষেত্রে দাবি করা যায়, অন্য কোন ভাবে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দাবি করা যায় না এবং খরিদ্দার যদি অমুসলিম হয় সেক্ষেত্রেওশুফার অধিকার দাবি করা যায় না।

মুসলিম আইনে হক শুফাবা অগ্রক্রয়ের অধিকার দাবির ক্ষেত্রে করণীয়

মুসলিম আইনে হক শুফাবা অগ্রক্রয়ের অধিকার দাবি করিতে হইলে দুইটি অত্যাবশ্যকীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করা জরুরী। যেমন—

(ক) তলব ই মৌসিবত অথার্ৎ শুফার দাবিদার কে বিক্রয় সংবাদ শুনার সাথে সাথে উক্ত বিক্রিত ভূমি ক্রয়ে তার অধিকার ঘোষণা করিতে হইবে।
(খ) তলব ই ইশাদ অথার্ৎ শুফার দাবিদার কে বিক্রয় সংবাদ শুনার সাথে সাথে বিক্রিত ভূমি ক্রয়ে তার অভিপ্রায় ঘোষণা করিতে হইবে।

উক্তরূপ ঘোষণারআনুষ্ঠানিকতা ক্রেতা বা বিক্রেতার উপস্থিতিতে বা বিক্রিত ভূমির অঙ্গনে সম্পাদন করিতে হইবে এবং সর্বনিম্ন দুই জন সাক্ষির সম্মুখে ঘোষণা করিতে হইবে।

মুসলিম আইনে অগ্রক্রয়ের দাবির ক্ষেত্রে তলব ই মৌসিবত এবং তলব ই ইশাদ প্রমান করা অত্যান্ত জরুরী। মোসাঃ রোকেয়া বেগম বনাম এ্যাড. আব্দুল আউয়াল এবং অন্যান্য মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ রায় দেয় যে মুসলিম আইনে অগ্রক্রয়ের দাবি করিতে হইলে হক শুফার অধিকারীকে বিক্রয় সংবাদ প্রাপ্ত হবার পর পরই লাফ দিয়ে তলব ই মৌসিবত ঘোষণা করিতে হইবে। সুতারাং শাফী কে যতদ্রুত সম্ভব তবল ই মৌসিবতের দাবি উত্থাপন করিতে হইবে। এমনকি শাফী যদি বিক্রয়ের সংবাদ শুনার পর ঘরে ঢুকিয়া বিক্রিত জমির মূল্য আনিয়া তারপর তলব ই মৌসিবত ঘোষণা করে, সেক্ষেত্রেও কলিকাতা হাইকোর্ট রায় দেয় যে এই বিলম্ব করাটা অনর্থক হইয়াছে। সুতারাং শাফী তাহার অধিকার হইতে বঞ্চিত হইয়াছে।

মুসলিম আইনে অগ্রক্রয়ে তামাদির সময়সীমা

মুসলিম আইনে হক শুফা বা অগ্রক্রয়ের অধিকার দাবি করে মামলা করার ক্ষেত্রে তামাদির কোন সময়সীমা উল্লেখ্য না থাকিলেও এক্ষেত্রে১৯০৮ সালের তামাদি আইনের অনুচ্ছেদ ১০ ও ১২০ প্রযোজ্য হইবে। অনুচ্ছেদ ১০ অনুসারে ক্রেতা তাহার ক্রয়কৃত ভূমিতে প্রত্যক্ষ দখল নেওয়ার তারিখ হইতে এক বছরের মধ্যে শুফার অধিকারীকে অগ্রক্রয়ের মামলা দায়ের করিতে হইবে। বিক্রীত ভূমি যদি এরূপ শ্রেনীর হয় যে বাস্তবে প্রত্যক্ষ দখল নেওয়া সম্ভব নয় সেইক্ষেত্রে বিক্রয় দলিল রেজিস্ট্রি হওয়ার তারিখ হইতে এক বছরের মধ্যে শুফার অধিকারীকে অগ্রক্রয়ের মামলা দায়ের করিতে হইবে। আর যদি বিক্রীত ভূমির প্রত্যক্ষ দখল নেওয়া সম্ভব না হয় এবং বিক্রয়ের কোন দলিলও রেজিস্ট্রি না হয় সেক্ষেত্রে তামাদি আইনের অনুচ্ছেদ ১২০ প্রযোজ্য হইবে।

মুসলিম আইনে অগ্রক্রয় মামলা করার সুবিধা

বর্তমানে মুসলিম আইনের পাশাপাশী রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহন ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর ৯৬ ধারা এবং অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৪৯ এর ২৪ ধারায় অগ্রক্রয়ের বিধান থাকিলেও উভয় আইনে অগ্রক্রয় মামলা করিতে হইলে বিক্রীত ভূমির সমুদয় বিক্রয় মূল্য এবং সাথে ক্ষতিপুরণ বাবদ বিক্রয় মূল্যের ১০—২৫% টাকা আদালতে জমা দিয়ে মামলা করতে হয়। কিন্তু মুসলিম আইনে অগ্রক্রয়ের মামলা করিতে হইলে মামলার শুরুতে এরূপ কোন টাকা আদালতে জমা দেওয়ার প্রয়োজন হয়না। এছাড়াও৯৬ ও ২৪ ধারায় শুধুমাত্র জমার সহ—শরীকগন অগ্রক্রয়ের দাবী করিতে পারিলেও মুসলিম আইনে জমারসহ—শরীক সহ সংলগ্ন ভূমির মালিক এবং বিক্রিত ভূমির উপর দিয়ে পথ ও পানি নিষ্কাশনের অধিকারী ব্যক্তিদেরও অগ্রক্রয়ের দাবীতে মামলা করার সুযোগ আছে।

লেখক: অ্যাডভোকেট; জজ কোর্ট, শরীয়তপুর। ই—মেইল: [email protected]



Source link

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *