বর্তমান সংবিধান সংরক্ষণ কেন বিপদজনক?


বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান: ৫ অগাস্ট চব্বিশের বিপ্লবের পর অন্তবর্তকালীন সরকার গঠনে সফল বিপ্লবের নিয়মনীতি অনুসরণ না করে বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানটি সংরক্ষণ ও অনুসরণ করে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের বিধানে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে “স্পেশাল রেফরেন্স নং ১/২০২৫” দাখিল করে সেই রেফারেন্সের অধীনে আপীল বিভাগের মতামত গ্রহণ করে অন্তর্বর্তিকালীন সরকার গঠন করা হয়। এই সরকার গত সাত মাসে ক্ষমতায় থেকে সংবিধান সংস্কার কমিটি, বিচারবিভাগ সংস্কার কমিটি সহ বেশ কটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কমিটি গঠন করে রাস্ট্রের মেরামত ও এক নতুন রাস্ট্রের বন্দোবস্ত তৈরীর কাজ করছেন। এই সকল কমিটি প্রদত্ত সংস্কার প্রস্তাব এখন রাজনৈতিক দলগুলির অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।  রাজনৈতিক দলগলি এসকল প্রস্তাবিত সংস্কার অনুমোদন করলে যে এসকল সংস্কার আগামী ডিসেম্বর ‘২৫ এর মধ্যে বাস্তবায়ন করে ২০২৬ এর জানুয়ারী থেকে জুনের মধ্যে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্য প্রধান উপদেস্ঠা ড. মুহাম্মদ ইউনুস তাগিদ দিয়েছেন। স্পস্টতঃ বোঝা যাচ্ছে যে এই সংস্কার সমূহ এবং নির্বাচন বর্তমান সংবিধান অনুসরণ করেই বাস্তবায়ন ও অনুস্টিত হবে।

সরকারের এই সংবিধান ও বিচার বিভাগ সংস্কার পদক্ষেপ বাস্তবায়ন যেহেতু বর্তমান সংবিধান অনুসরন করেই বাস্তবায়ন করার জন্য সরকার বদ্ধপরিকর, সেহেতু এই বাস্তবায়নে সাংবিধানিক অক্ষমতার বিষয়টি আলোচনার বাইরে রেখে শুধুমাত্র সংবিধান সংরক্ষন ও অনুসরনের মহাবিপদটির তথ্য জাতির সামনে তুলে ধরতে চাই। যদিও বর্তমান অন্তর্বর্তিকালিন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে মহা বিজ্ঞজনরা দায়িত্ব পালন করছেন, কিন্তু অবধারিত বিপদাশঙ্কা সম্পর্কে তারা অবহিত নন সেটি বিশ্বাস করা কষ্টকর।

সংবিধান সংরক্ষণ ও অনুসরণের বিপদের প্রথম যে বি়ষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটি প্রথমে আলোচনা করা যাক।

এ বিষয়ে কোন গ্যারান্টি নেই যে ভবিষ্যতের কোন এক সময়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এর মতো প্রধান বিচারপতি বাংলাদেশে পুনরায় জন্ম গ্রহণ করবেন না এবং সে ও তার দোসর বিচারপতিরা মিলে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন ও আপীলেট ডিভিশনের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে এরূপ রায় দেবেন না- যে বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের ভিত্তিমূলে গঠিত চলমান “অন্তর্বর্তিকালীন সরকার” গঠন করার জন্য আপীল বিভাগের যে মতামত গ্রহণ করা হয়েছিল সেটি সঠিক পদ্ধতিতে প্রদত্ত হয়নি এবং প্রেরিত প্রশ্নটি আইনগত প্রশ্ন না হওয়ায় এবং সেটি একটি সাংবিধানিক প্রশ্ন হওয়ায় ঐ মতামত প্রদান অসাংবিধানিক ছিল। ফলে ঐ মতামতের অধীনে গঠিত অন্তর্বর্তিকালীন সরকার একটি অবৈধ সরকার ছিল এবং এর সকল কার্যক্রম বেআইনী হওয়ায় এই সরকারের জারী করা রাষ্ট্র মেরামতকারী সকল আইন, সাংবিধান সংস্কারকারী সকল পদক্ষেপ অবৈধ ও কার্যকারিতা বিহীন।

ভবিষ্যতের খায়রুল হক গং বিচারপতিরা একই সাথে এও ঘোষণা করতে পারেন যে অবৈধভাবে সংবিধান সংশোধন করায় সেটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ক এবং ৭খ এর বিধান প্রয়োগযোগ্য হয়েছে। ফলে ঐ অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল উপদেষ্টা ও ব্যক্তিবর্গ রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অপরাধী হওয়ায় ফৌজদারি বিচারিক কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যদন্ড কার্যকর করা যেতে পারে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকান্ড এবং সেই সময়ের সরকার গঠনকে বৈধতা দিয়ে যে ইমডেমনিটি অর্ডিনেন্স ১৯৭৯ সংসদে পাশ করা হয়েছিল ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে ঠিক এই পদ্ধতিতেই সেই ইমডেমনিটি অর্ডিনেন্স বাতিল করে দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল।

ভবিষ্যতের বিচারপতি খায়রুল হক গংরা বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে তাদের সম্ভাব্য রায়ে যুক্তি তুলে ধরতে পারেন যে-

সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের বিধানে সুপ্রীম কোর্টের যে উপদেষ্টামুলক এখতিয়ার আছে, তাতে সুপ্রীম কোর্টের মতামত শুধু সেই ক্ষেত্রেই গ্রহণ করা যেতে পারে, যখন  ‘আইন’ এর এইরূপ কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে বা উত্থাপনের সম্ভবনা দেখা দিয়েছে যা এমন জন-গুরুত্বসম্পন্ন যে, সেটি শুধু মাত্র ‘আইনের প্রশ্ন’ হওয়ায় সেটি সম্পর্কে সুপ্রীম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন। ২০২৪ সালে ৫ অগাস্টের পর দেশে সরকারবিহীন অবস্থায় যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, সেই সরকারের বৈধতার প্রশ্নটি একটি ‘সাংবিধানিক প্রশ্ন’ হওয়ায় সে প্রশ্নটি ‘আইনের প্রশ্ন নহে’। ফলে সুপ্রীম কোর্টের ১০৬ অনুচ্ছেদের এই এখতিয়ারে সাংবিধানিক প্রশ্নের উপর মতামত গ্রহণ করার কোন অবকাশ ছিলনা এবং সুপ্রীম কোর্টের যে মতামত গ্রহণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে সেটি বৈধ নয়।

এই বিচারপতি খায়রুল হক গংরা আরো যুক্তি প্রদর্শন করতে পারে যে, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে মতামত প্রদানকালে সুপ্রীম কোর্টকে সংবিধানের অভ্যন্তরের বিধানের মধ্য থেকেই মতামত প্রদান করতে হবে। সংবিধান বহির্ভুত কিংবা নিজ সু-বিবেচনা (Discretion) কিংবা পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো (Rule of necessity) কোন মতামত প্রদানের কোন অবকাশ নেই। সংবিধানে যেহেতু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কোন বিধান নেই, সেহেতু বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক বিগত ৮ অগাস্ট ২০২৪ তারিখে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রদত্ত মতামত তথা “রাস্ট্রের সাংবিধানিক শুন্যতা পূরণের জরুরী প্রয়োজনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্য পরিচালনার নিমিত্তে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসাবে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টা নিযুক্ত করতে পারবেন। মহামান্য রাস্ট্রপতি উক্তরূপে নিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টাগণকে শপথ পাঠ করাতে পারবেন” মর্মে প্রদত্ত মতামত সংবিধান অনুযায়ী বৈধ নয়।

ভবিষ্যতের এই বিচারপতি খায়রুল হক মার্কা বিচারপতিরা আরো যুক্তি দেখাতে পারেন যে, সংবিধানে প্রদত্ত সরকার গঠনের বিধান ভঙ্গক্রমে যেহেতু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে, সেহেতু এই কার্যক্রম সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদের সাংঘর্ষিক হওয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সকল সদস্য বর্তমান রাষ্ট্রপতিসহ রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হওয়ায় তারা ঐ অনুচ্ছেদ অনুযাযী মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হওয়ার যোগ্য অপরাধ করেছেন।

ভবিষ্যতের এই বিচারপতি খায়রুল হক জাতীয় বিচারপতিদের উত্থাপিতব্য সম্ভাব্য আইনী জটিলতার এই বিষয়গুলি পর্যালোচনায় নিলে দেশের অভিজ্ঞ আইনজ্ঞরা ঠিক কতটা বিরুদ্ধ যুক্তি তুলতে পারবেন সেটা বিবেচনা যোগ্য।

এটি অনস্বীকার্য যে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি দেশের বিশেষ অবস্থায় সুপ্রীম কোর্টের কাছে “আইন”এর জটিল বিষয়ে মতামত গ্রহণের জন্য রেফারেন্স প্রেরণ করতে পারবেন। তবে এই রেফারেন্সের উত্তর প্রদানকালে আপিল বিভাগ “স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানীর পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় মতামত জ্ঞাপন করিতে পারিবেন”।

বিগত ৮ অগাস্ট ২০২৪ তারিখে মহামান্য রাস্ট্রপতি “আইনের প্রশ্ন” রূপে যে প্রশ্নটি আপীল বিভাগের মতামত গ্রহণে জন্য প্রেরণ করেছিলেন সেটি নিছক একটি “সাংবিধানিক প্রশ্ন” যা আইনের প্রশ্নের আবরনে মতামতের জন্য আপীল বিভাগে প্রেরণ যোগ্য নয় এবং এই সাংবিধানিক প্রশ্নের ওপর আপীল বিভাগের মতামত দেয়ার কোন অবকাশ নেই।

অভিজ্ঞ আইনজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে যে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে আপীল বিভাগের সার্বিক (প্লেনারী) কিংবা সুবিবেচনা প্রসূত (ডিসক্রিশনারী) ক্ষমতা নেই। অভিজ্ঞ আইনজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে যে এই “স্বীয় বিবেচনা” আপীল বিভাগকে সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ দেয় নাই। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মতামত প্রদান করতে হলে আপীল বিভাগকে সংবিধানের মধ্যে থেকেই মতামত প্রদান করতে হবে।

এই অবস্থায় অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ (জুরিস্ট) দের আশঙ্কা হচ্ছে ভবিষ্যতে এইরূপ জটিলতা সৃষ্টির বীজ আমরা নিজ অজ্ঞতায় বপন করে ফেলেছি- যেটি মহীরূহ হয়ে ভবিষ্যত খায়রুল হক জাতীয় বিচারপতিদের হাতে একটি শক্ত হ্যান্ডেল প্রদান করতে পারে।

সংবিধান সংরক্ষণ ও অনুসরণ সংক্রান্ত বিপদের দ্বিতীয় যে বি়ষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে সংবিধান সংস্কার কমিটির সংস্কার প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত। যেহেতু এখন সংসদের অস্থিত্ব নেই সেহেতু জনৈক বিজ্ঞ সংবিধান বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন যে “অধ্যাদেশ জারীর মাধ্যমে সংবিধান সংশোধিত হতে কোন বাধা নেই।” এমন হাস্যকর ও বে-আইনি পরামর্শ অনুসরণ করে যদি সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়ন করা হয়, তবে ভবিষ্যতের খায়রুল হক মার্কা বিচারপতির এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার প্রয়োজন পড়বেনা- বরং এই সরকারের অনুগত বিচারপতি মহোদয়গণ এই ধরনের সংবিধান সংশোধনকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিতে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এমনকি পরবর্তি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের এই ধরনের সংবিধান সংশোধন অধ্যাদেশ বাতিলক্রমে নতুন আইন প্রণয়ন করতে কোন বাধা থাকবেনা।

প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক রেওয়াজ অনুযায়ী একটি সফল বিপ্লব ল বিদ্যমান সংবিধানকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত (বাতিল নয়) করে দেয় এই কারণে যে বিদ্যমান সংবিধানটি পতিত স্বৈরাচারের অনাচারের বাহন ও হাতিয়ার হিসেবে কার্যকর ছিল। একথা কেউ অস্বীকার করবেন না যে বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানটি চতুর্দশ সংশোধনী থেকে পঞ্চদশ সংশোধনীর দ্বারা কিরূপ ভয়ংকরভাবে স্বৈরাচারের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছিল। এ সংবিধানের ৭ক ও ৭ খ এর বিধানে শুধুযে পরবর্তি সংসদের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে তাইই নয়, বরং সংবিধান সংশোধন করার যেকোনো প্রচেষ্টাকে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধ রূপে সাংবিধানিকভাবে ধার্য করা হয়েছে। এরূপ একটি ভয়ংকর ও স্বৈরাচার বিধানের সংবিধানকে একটি সফল বিপ্লব পরবর্তি সরকারের অনুসরণ করা যে কতটা বোকামি ও বিপদজনক সেটা বলাই বাহুল্য।

দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করতে পারেন যে আপীল বিভাগে সংবিধানের  পঞ্চদশ সংশোধনী সংক্রান্ত যে রিভিউ দরখাস্ত চলমান আছে সেটির মাধ্যমে পঞ্চদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার মাধ্যমে বাতিল হয়ে গেলেই তো ল্যাটা চুকে যায়। আমার সবিনয় উত্তর হচ্ছে- না তাতে বিষয়টির সমাধান হবেনা। কেননা সংবিধান বলবত আছে বিবেচনা করলে ইতোমধ্যে সংবিধানের নির্বাচনের বিধানসহ অপর যে সকল বিধান ভঙ্গ হয়ে গেছে সেসকল বিষয়ে পুনরায় সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে আপীল বিভাগের মতামত গ্রহণ করে সম্মুখে অগ্রসর হলে, এখন হয়তো সাময়িক সমস্যাদির উত্তরণ হবে, কিন্তু ভবিষ্যতের খায়রুল হক গং মার্কা বিচারপতিরা একই কায়দায় এসকল বিষয়াবলীকে অবৈধ ঘোষণা করতে নিজের হাতে শক্ত হ্যান্ডেল প্রাপ্ত হবেন। ফলে এ সংক্রান্ত সকল পদক্ষেপ ফলহীন হয়ে যাবে।

এই জটিল অবস্থা থেকে উত্তরণে একমাত্র পন্থা হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত “জুলাই সনদ” এ  ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখের বেলা ২.৩০ মিনিটে সফল বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার ঘোষণা এবং ঠিক সেই সময় থেকে বিদ্যমান সংবিধানটির বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সংক্রান্ত ঘোষণা থাকা। সফল বিপ্লবের মাধ্যমে বিদ্যমান লিগ্যাল অর্ডার পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার ভূরিভূরি দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে রয়েছে।  বিগত দুটি শতকে পৃথিবীতে যে কটি সফল বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে তার মধ্যে ১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লব, ১৯১৭ সালে বলশেভিক (রাশিয়ান) বিপ্লব এবং ১৯৭৯ সালে ইরান বিল্পব এবং এর মধ্যে অন্যতম সাম্প্রতিক কালের সর্বশেষ ২০১১ সালে তিউনেশিয়া বিপ্লব হচ্ছে আর একটি উল্লেখযোগ্য বিপ্লব।

এই সফল বিপ্লবগুলির পরিণতিতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির স্বৈরাচারী সরকারের পতন হলে সেদেশের চলমান লিগ্যাল অর্ডারটি পরিবর্তন হয়ে যায় এবং একটি নতুন লিগ্যাল অর্ডার শুরু হয়। বাতিল হয়ে যাওয়া পুরাতন লিগ্যাল অর্ডারের মধ্যে সেদেশে সংশ্লিষ্ট সময়ে প্রচলিত সাংবিধানিক বিধি বিধান বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তি বিপ্লবী সরকার নতুন সাংবিধানিক বিধিবিধানের প্রণয়ন করে তার অধীনে দেশের সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এরূপ দৃষ্টান্ত থাকা স্বত্বেও যে ভুল আমরা ইতোমধ্যে করে ফেলেছি সে ভুল সংশোধনের একমাত্র পন্থা হচ্ছে প্রস্তাবিত “জুলাই সনদ”এ সংবিধান বিলুপ্তির স্বীকৃতি অন্তর্ভুক্ত করা এবং একই সঙ্গে পরবর্তি নির্বাচনটি “গণপরিষদ” এর নির্বাচন হওযার বিধান থাকা এবং সেই গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রনয়ন করে তার অধীনে পরবর্তি পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

আলোচিত বিষয় অনুযায়ী আমাদের পরবর্তি কার্যক্রমের নিম্নরূপ রোডম্যাপ হতে পারে-

(১) “জুলাই সনদ” জারী করে হাসিনা সরকারের পতন ও সেই প্রেক্ষিতে জুলাই-অগাস্ট আন্দোলনকে “ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান” তথা “বিপ্লব” এ রুপান্তরিত হওয়া বিবেচনা করার ঘোষণা দেয়া।

(২) “জুলাই সনদ” এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্ট্যাটাস বিপ্লবী পরিষদ (Revolutionary Council) হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা।

(৩) জুলাই-অগাস্ট এর “সফল বিপ্লব” এর ফলশ্রুতিতে বিদ্যমান বাংলাদেশের সংবিধান স্বয়ংক্রিয় ভাবে বিলুপ্ত হয়েছে বিবেচনার ঘোষণা দেয়া।

(৪) “জুলাই সনদ”এর  ক্ষমতার অধীনে একজন নতুন রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন ও নিয়োগ করার ঘোষণা থাকা।

(৫) স্বৈরাচার সরকার কর্তৃক সৃষ্ট রাষ্ট্রীয়, প্রশাসনিক, বিচারিক ও আর্থিক সকল প্রতিষ্ঠানের বিশৃঙ্খলার সংস্কার সাধন করার ঘোষণা থাকা।

(৬) “জুলাই সনদ” এর অধীনে সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করার ঘোষণা থাকা।

(৭) নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যদের দ্বারা নতুন সংবিধান প্রণয়ন করার ঘোষণা থাকা।

(৮) নতুন সংবিধান প্রনীত ও গৃহীত হওয়ার পর গণপরিষদটি “পরবর্তি সংসদ” হিসাবে বিবেচনা করার ঘোষণা দেয়া।

(৯) নতুন রাষ্ট্রপতির আহ্বানে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের দ্বারা সরকার গঠন করা।

(১০) নতুন সরকারের হস্তে ক্ষমতা হস্তান্তর করা ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিলুপ্ত করা।

শেষ করার আগে সবিনয়ে আবারো মনে করিয়ে দিতে চাই, ৫ অগাস্ট ২০২৪ এ স্বয়ং বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সংবিধানটিকে জীবিত থাকা বিবেচনায় যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্মুখে অগ্রসর হতেই থাকে, তবে হাজার জীবনের রক্তদানের বিনিময়ে অর্জিত দ্বিতীয় স্বাধীনতা শুধু যে ম্লান হয়ে যাবে তাই নয়- বরং এই বিপ্লব সংঘটনকারী সূর্য সন্তানদের সহ আজকের সরকার পরিচালনাকারী সকল উপদেষ্টা এবং সংশ্লিষ্ট সকলের জীবন বিপন্ন হয়ে যাবে। অতএব সাধু সাবধান!

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।



Source link

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *