প্রধান বিচারপতি নিয়োগের নীতিমালা চূড়ান্ত পর্যায়ে
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে নেই কোন নীতিমালা। তবে নীতিমালা প্রণয়নের ওপর জোর দিয়েছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। শুধু উচ্চ আদালত নয়, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারকসহ প্রধান বিচারপতি নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন অনেকটাই চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
আগামীকাল রোববার (২৭ অক্টোবর) কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে আরো শক্তিশালী করতে কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে সুপারিশ করবে কমিশন। বর্তমানে কাউন্সিলের সভাপতি প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ এবং সদস্য রয়েছেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ দু’জন বিচারক।
কমিশন মনে করছে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে শক্তিশালী করতে এর সদস্য সংখ্যা ৮/৯ জন করা উচিত। কমিশনের একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
গত ৩ অক্টোবর আট সদস্যের বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করে দেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিচার বিভাগকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়নের লক্ষ্যে এই কমিশন গঠন করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সকল মতামত বিবেচনা করে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন প্রস্তুত করে তা প্রধান উপদেষ্টার নিকট হস্তান্তর করতে বলা হয় কমিশনকে। কমিশনের প্রধান করা হয় আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে। দায়িত্ব পেয়ে কমিশন ইতিমধ্যে ৭টি বৈঠক করেছেন। বৈঠকে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে কমিশন।
কমিশন সূত্র জানায়, বিগত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যোগ্যতা ও দক্ষতার বিষয়টি বিবেচনা না করেই ঢালাওভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় উচ্চ আদালতে অনেক বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেই সব নিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট অংশীজনরা নানা প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। কিন্তু তাতে বিচারক নিয়োগ আটকানো সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন: বিচার বিভাগ সংস্কারে প্রথম বৈঠকে এজেন্ডা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত
উচ্চ আদালত ছাড়াও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে একের পর এক বিচারক নিয়োগ করা হয়েছে জ্যেষ্ঠতা লংঘন করে। একাধিক প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছে জ্যেষ্ঠতা লংঘন করে। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক হওয়ার পরেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চারজন বিচারপতিকে বঞ্চিত করা হয়েছে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেওয়া থেকে।
প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ না পেয়ে বিচারক পদে মেয়াদ থাকার পরেও পদত্যাগ করেন তিনজন বিচারপতি। ছুটিতে যান একজন। অতীতে আপিল বিভাগে নিয়োগ না পাওয়া এবং জ্যেষ্ঠতা থাকার পরেও প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ না পাওয়া বিচারকদের হতাশা ও বঞ্চনার বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগের নীতিমালা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন।
এই নীতিমালায় প্রধান বিচারপতি, আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ কীভাবে হবে তা চূড়ান্ত রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। এই নীতিমালায় বাংলাদেশ বার কাউন্সিল, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকবে।
সূত্র জানায়, উচ্চ আদালতে দুই বছর অতিরিক্ত বিচারক হিসাবে দায়িত্ব পালনের পর অনেক বিচারককে স্থায়ী করা হয় না। ভবিষ্যতে যেন কেউ স্বেচ্ছাচারীভাবে এরকম সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন সেজন্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিটির কথা নীতিমালায় বলা হয়েছে। এছাড়া একজন জেলা জজকে উচ্চ আদালতের বিচারক হিসাবে নিয়োগ দেওয়ার পূর্বে সর্বশেষ দুটি কর্মস্থলে তার কর্মকান্ড কেমন ছিলো সে ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার বিষয়টি নীতিমালায় রাখা হচ্ছে।
এছাড়া সুপ্রিম কোর্ট ও নিম্ন আদালতের বিচারকদের দুর্নীতি ও গুরুতর অসদাচরণের বিষয়ে নজরদারি করতে পৃথক একটি উচ্চ পর্যায়ে কমিশন করার সুপারিশ করা হচ্ছে। এই কমিশন বছরজুড়ে বিচারকদের ওপর নজরদারি করবেন। যাতে বিচারকরা দুর্নীতি ও অসদাচরণের আশ্রয় নিতে না পারেন। আর দুর্নীতির আশ্রয় নিলেও যেন তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়।
আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরও ৫ প্রসিকিউটর নিয়োগ
কমিশন মনে করছে, এসব নজরদারির ব্যবস্থা না থাকলে বিচার বিভাগকে পুরোপুরি শুদ্ধতম পর্যায়ে নেওয়া সম্ভব হবে না।
প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছিলো। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে তখন সেটা কার্যকর করা হয়। ওই নীতিমালার ভিত্তিতে তখন উচ্চ আদালতে ছয়জন বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়।
কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালাটি সংসদে পাস না করায় তা বাতিল হয়ে যায়। ফলে গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক বিচারক নিয়োগ হলেও তাদের অনেকের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে।
Leave a Reply