নামমাত্র খরচ বৃদ্ধির অজুহাতে ব্যাপক মুনাফা, ৭ কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা


ডলার ও কাঁচামালের আমদানি খরচে ‘নামমাত্র’ ব্যয় বাড়লেও এই অজুহাতে উৎপাদন ও সরবরাহকারী বেসরকারি কোম্পানিগুলো আধা লিটারের বোতলজাত পানির দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৪২০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা বাড়িয়েছে বলে উঠে এসেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের (বিসিসি) এক অনুসন্ধানে।

সেখানে উৎপাদন ও সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদিত পানির মূল্য যোগসাজসের মাধ্যমে ‘অস্বাভাবিকভাবে নির্ধারণ’ করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কোকাকোলা বাংলাদেশ বেভারেজ লিমিটেড, ট্রান্সকম বেভারেজ, মেঘনা বেভারেজ, পারটেক্স বেভারেজ, রুপসী ফুডস (সিটি গ্রুপ), আকিজ ফুড এন্ড বেভারেজ এবং প্রাণ বেভারেজ লিমিটেড– এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন।

কমিশনের সদস্য মো. হাফিজুর রহমান কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

কমিশনের ‘বোতলজাত পানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে’ উঠে এসেছে, বোতলজাত পানির উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রথম সারির (মার্কেট শেয়ারের ভিত্তিতে) কোম্পানিগুলো ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে হঠাৎ করে আধা লিটার পানির বোতলের দাম ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা নির্ধারণ করে। এই দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলো ডলার ও কাঁচামালের কারণে বেড়ে যাওয়া আমদানি খরচকে দায়ী করে।

তবে কোম্পানিগুলোর উৎপাদন খরচ বিশ্লেষণ করে কমিশন দেখতে পায়, নামমাত্র উৎপাদন খরচ বাড়লেও দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে মূলত কোম্পানিভেদে মুনাফা বাড়ানো হয়েছে ৭১.২৩ শতাংশ থেকে ৪২০ শতাংশ পর্যন্ত। প্রফিট মার্জিন বেড়েছে ডিস্ট্রিবিউটর ও খুচরা বিক্রেতার।

ঢাকা ওয়াসা-সহ মোট ৮ কোম্পানির উৎপাদন খরচ বিশ্লেষণ করা হয় অনুসন্ধান পর্যায়ে। এরমধ্যে ওয়াসা ছাড়া বাকি ৭টি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে।

৪২০ শতাংশ মুনাফা করেছে আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ

পানির দাম বাড়িয়ে যেসব কোম্পানি অতিরিক্ত মুনাফা করেছে, তাদের একটি অকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ। কমিশনের তথ্যমতে, স্পা ব্র্যান্ড নেমের অধীনে আধা লিটার পানির দাম ৫ টাকা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ৪২০ শতাংশ মুনাফা করেছে কোম্পানিটি।

প্রতিষ্ঠানের ১৮.৩৩ শতাংশ উৎপাদন খরচ ও ভ্যাট-ট্যাক্স এর কারণে ৩১.৭৮ শতাংশ খরচ হলেও কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪২০ শতাংশ।

দাম বৃদ্ধির আগের আকিজের আধা লিটার পানি বিক্রি করে খুচরা বিক্রেতা পেতেন ৫.৬২ টাকা— যা দাম বৃদ্ধির পর ৯ টাকা হয়েছে।

একইভাবে, কোকাকোলার কিনলে ব্র্যান্ডেড ৫০০ মি.লি. বোতলজাত পানির উৎপাদন খরচ বেড়েছে ১.৬২৪ টাকা, যা শতাংশের হিসেবে ২৭.৬৭ শতাংশ এবং ভ্যাট-ট্যাক্স ও সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি ৩৩.৮৫ শতাংশ বেড়েছে।

৫ টাকা মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে কোম্পানি তাদের মুনাফা বাড়িয়েছে ২১১.৬২ শতাংশ। এতে ডিস্ট্রিবিউটর পর্যায়ে মুনাফা বেড়েছে ৩০.১৩ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে বেড়েছে ২৬.৯৮ শতাংশ।

কিনলের আধা লিটারের একটি পানির বোতল ১৫ টাকা বিক্রি করে খুচরা বিক্রেতা আগে ৬.৬৭ টাকা মুনাফা করতেন, এখন সেটির দাম ৫ টাকা বাড়ানোর পর মুনাফা করছেন ৮.৪৭ টাকা।

একইভাবে, ট্রান্সকম বেভারেজের মুনাফা ৭১.২৩ শতাংশ এবং মেঘনা বেভারেজ লিমিটেডের মুনাফা ১৭৭.৭৮ শতাংশ বেড়েছে বলে উঠে এসেছে তদন্তে।

কমিশনের পর্যবেক্ষণ বলছে, সিটি গ্রুপ অপর্যাপ্ত তথ্য দেওয়ায় ও প্রাণ কোন প্রকার তথ্য সরবরাহ না করায় তাদের মুনাফার পরিমাণ বিশ্লেষণ করা যায়নি। শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠান, পারটেক্স বেভারেজ দাম বাড়িয়ে ডিস্ট্রিবিউটর ও খুচরা বিক্রেতাদের কমিশন বাড়ালেও কোম্পানির মুনাফা বাড়ায়নি।

এছাড়া, ঢাকা ওয়াসার শান্তি ব্র্যান্ডের পনির উৎপাদন খরচ বাড়েনি এবং তারা প্রতিষ্ঠানের, ডিস্ট্রিবিউটর এবং খুচরা বিক্রেতার কমিশনও বাড়য়ানি। এতে করে অবশ্য প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায় ধাক্কাও খাচ্ছে। ১৫ টাকায় পানি বিক্রি করে লাভ কম হওয়ায় তাদের পানি খুচরা বিক্রেতারা দোকানে রাখতে চান না বলে জানা গেছে।

প্রতিযোগীতামূলকভাবে দাম নির্ধারণ না করে পারস্পারিক যোগসাজসের মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে প্রতিযোগীতা আইন, ২০১২ এর ধারা ১৫(১), ১৫(২)(ক)(অ) ও ১৫(২)(খ) লঙ্ঘন করেছে কোম্পানিগুলো।

যেভাবে অনুসন্ধান শুরু করে কমিশন

গত বছরের মাঝামাঝিতে গণমাধ্যমে পানির দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সমালোচনা শুরু হয়; যেখানে উঠে আসে আধা লিটার পানিতে খুচরা বিক্রেতার লাভ হয় ৮–৯ টাকা।

বিষয়টি নিয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া কমিশনের কাছে পানির বাজারে কোম্পানিগুলোর যোগসাজশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার আবেদন জানান।

এ অবস্থায় কমিশন সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে। একইসঙ্গে, কাছে কস্ট শিট বিশ্লেষণ করে সুপারিশসহ তাদের মতামত প্রদানের জন্য ট্যারিফ কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং কমিশন তাদের নিজস্ব অনুসন্ধান শুরু করে।

পানির বাজার এবং মার্কেট শেয়ার

কমিশনের পর্যালোচনা অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের হিসেবে দেশে বোতলজাত পানি বিক্রি হয়েছে ৫৫ কোটি ২৪ লাখ ৫৯ হাজার লিটারের বেশি। আর ২০২২-২৩ (৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত) অর্থবছরে বিক্রি হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি লিটার।

এখানে সবচেয়ে বেশি পানি বিক্রি হয়েছে ফ্রেশ ব্র্যান্ডের। প্রতিষ্ঠানটির মার্কেট শেয়ার ছিল ২৪.১৭ শতাংশ। ১৭.৭৬ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল প্রাণ, ১৬.৮৮ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে ছিল অ্যাকুয়াফিনা।

এছাড়া, ১৬.৪৪ শতাংশ নিয়ে চতুর্থ অবস্থানে মাম, ১৩.৮১ শতাংশ নিয়ে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে স্পা। এছাড়া, কিনলের ৪.১৬ শতাংশ, জীবন ব্র্যান্ডের ৪ শতাংশ এবং মুক্তা, সেনা, মুসকান ও শান্তি পানির প্রতিটি ব্র্যান্ডের মার্কেট শেয়ার ১ শতাংশের কম।

এদিকে, বিএসটিআই বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের হিসেবে দেশে বোতলজাত খাবার পানি উৎপাদন ও বাজারজাতকারী নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৩২টি। এরমধ্যে উল্লিখিত ১১টি ব্র্যান্ডের দখলেই রয়েছে মূলত বোতলজাত পানির বাজার।



Source link

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *