ধর্ষণের অপরাধ এবং বিচারের পদ্ধতি- সরকারের দায়বদ্ধতা
মোঃ ওবাইদুল্যাহ আল মামুন সাকিব : ধর্ষণ, পৃথিবীতে প্রচলিত যত ধরনের নিকৃষ্টতর অপরাধ রয়েছে; তারমধ্যে সবচেয়ে ঘৃণিত একটি অপরাধ। আইনের ছাত্র এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নিয়মিত প্র্যাকটিশনার/আইনজীবী হিসেবে স্ব অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, এই ধরনের অপরাধ এবং মামলায় প্রকৃত অপরাধকে সনাক্ত করা বা ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা দূরহ!
২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন পাশ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ১৯৯৫ অনুসারে ধর্ষণের বিচার করা হতো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দুইটি আইনই দণ্ড বিধি ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় সংজ্ঞায়িত ধর্ষণ অপরাধের বিচার করা হতো। সরকার বিশেষ আইনের প্রয়োজনে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ১৯৯৫ কে রহিত করে ২০০০ সালে নতুন আইন পাশ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধর্ষণ মামলা নিষ্পত্তির বিধান প্রনয়ণ করে। এই আইন পাশ হওয়ার পর ধর্ষণ মামলা কমেনি বরং ধর্ষণ আরো বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই আইনের ধারা ৯(১) এবং ৯(৩) এ ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড সহ অর্থদণ্ডের বিধানও রাখা হয়েছে। কিন্তু এই জঘন্যতম অপরাধের মাত্রা কমেনি বরং প্রতিনিয়ত এই অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরাধ আদৌও কমেনি ; ভবিষ্যতেও এই অপরাধ কমবে না। এটা শতভাগ নিশ্চিত মনে রাখবেন।
ধারা ২০(৩) অনুযায়ী, বিচারের জন্য মামলা প্রাপ্তির তারিখ (চার্জ গঠন) থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলা নিষ্পত্তি করতে আইনে বলা থাকলেও বাস্তবে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। ধর্ষণ মামলা নিষ্পত্তি করতে বর্তমান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ৯০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির মতামত দিয়েছেন। ৯০ দিনের মধ্যে বিচার নিষ্পত্তি করা যেই কথা আর ১৮০ দিনের মধ্যেও সেই একই কথা! বিচার বিভাগ চাইলে বিচার দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে পারেন। তবে, এক্ষেত্রে জনবল, প্রয়োজনীয় লজিস্টিকস সাপোর্ট প্রদান করতে পারলে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন: ধর্ষণ মামলায় জামিন নিষিদ্ধ: ন্যায়বিচার নাকি বাড়তি ঝুঁকি?
দেশে প্রতিদিনই ধর্ষণসহ নিকৃষ্ট অপরাধ ঘটছে কিন্তু জনগণ বিশেষ করে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে। সরকারকে দ্রুতসময়ের মধ্যে জবাবদিহিমূলক বিচার বিভাগ গড়ে তুলতে হবে। এই ধরনের মামলা কীভাবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা যাবে, মেডিকেল সার্টিফিকেট, পুলিশ প্রশাসন সহ যাবতীয় কার্যাবলী নিষ্পত্তির জন্য সরকারের সদিচ্ছার অভাবের কারণেই ইতোপূর্বে মামলা জট লেগে আছে!
এখন শুরু হলো, মামলা নিষ্পত্তির ব্যবচ্ছেদ! নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা হচ্ছে, গণহারে মিথ্যা মামলা রুজু। প্রায় অধিকাংশ ধর্ষণের মামলায় আসামি খালাস পান। ফলে অপরাধের মাত্রা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রাষ্ট্র কাঠামোর সংষ্কার করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দৃশ্যমান নয়। মাগুরাতে ৮ বছরের শিশুকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যেটা নিয়ে বাংলাদেশে তোলপাড় শুরু হয়েছে। অনেকে সরকারকে তুলোধুনো করছে। কিন্তু আমি জনগণকে প্রশ্ন করতে চাই, যেই নিকৃষ্টতর ব্যক্তি এই জঘন্যরকম অপরাধ ঘটিয়েছে, সে কি সরকারের লোক নাকি সরকারের ছত্রছায়ায় এই ধর্ষণ ঘটিয়েছে?
ধর্ষণ মামলা নিষ্পত্তি করতে হলে সবার আগে সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে। বিচারিক কার্যক্রম সহজ করা, মেডিকেল সার্টিফিকেট, পুলিশ, বিচারক, আইনজীবী সবাইকে মানসিকভাবে পরিবর্তন করতে হবে। শাস্তি প্রয়োগের পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করার প্রক্রিয়ায় দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে হবে তবেই অন্য অপরাধীও পরবর্তীতে অপরাধ করতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠবে।
শুধু শুধু আইনের দোহাই দিয়ে অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং অপরাধীদের জন্য অভয়ারণ্য তৈরি না করে জনগণের পালস অনুভব করতে হবে। প্রয়োজনে ৫টি মামলায় পরীক্ষামূলক শাস্তির ব্যবস্থা করেন। দেখা যাবে, বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে ৫০ ভাগ অপরাধ কমে যাবে আগামী ১ মাসের মধ্যে। সরকার যদি একটা উদ্যোগ নেয় ; প্রকাশ্যে উন্মুক্তস্থানে বিচার, কার্যকর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োগ, এবং সর্বত্র সচেতনতা বৃদ্ধি করে; তাহলে যে কেউ অপরাধ করতে দ্বিধাবোধ করবে। তবেই অপরাধের সংখ্যা কমতে থাকবে, অন্যথায় এই ধরনের অপরাধ পুনঃপুন ঘটবে এবং মানুষ পুনঃপুন শাস্তি চাইতেই থাকবে!
লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক এবং অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।
Leave a Reply