চারিদিকের গুজব রুখবে কে!


আবু হাসনাত তুহিন: বাংলাদেশে গুজব ছড়ানোর বিষয়টি বর্তমানে একটি ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। ইন্টারনেটের প্রসার, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে গুজব খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ফলে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও বৈষম্য বাড়ছে যা দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।

এই অবস্থায় ছাত্রসমাজ এবং তরুণ প্রজন্মের দায়বদ্ধতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গুজবের ফলে অনেক মানুষ বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে এবং সমাজের ক্ষতি হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে চারিদিকে ছড়ানো এসব গুজব রুখবে কে! গুজব নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিগত সচেতনতা, প্রযুক্তি ব্যবহার, পারস্পরিক সহাবস্থান এবং প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি।

গুজবের প্রভাব

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে গুজবের কারণে বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে “ছেলে ধরা” গুজবের কারণে কয়েকটি এলাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং নির্দোষ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

একইভাবে, করোনা মহামারির সময় নানা গুজব ছড়ানো হয়—যেমন ভ্যাকসিন নিয়ে ভুল তথ্য এবং সংক্রমণের বিষয়ে বিভ্রান্তি।

সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন থেকে স্বৈরাচারের পতন ও এর পরবর্তী সময়ে এই গুজব আরো ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। এসব গুজবের কারণে মানুষ সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে, যা সমাজের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে।

প্রযুক্তির ভূমিকা

সামাজিক মাধ্যম যেমন ফেসবুক, ইউটিউব এবং টিকটকের মাধ্যমে গুজব খুব দ্রুত ছড়ায়। কিন্তু প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমেই গুজব রোধ করাও সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, ফেসবুক এবং টুইটার এখন গুজব বা ভুল তথ্য শনাক্ত করতে বিভিন্ন ফ্যাক্ট-চেকিং টুল ব্যবহার করছে।

ফেসবুকে “ফ্যাক্ট-চেকার” প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে যা বিভিন্ন পোস্টের সত্যতা যাচাই করে। বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ আরো বিস্তৃত করা জরুরি, যাতে অনলাইনে ছড়ানো ভুল তথ্য দ্রুত শনাক্ত করা যায় এবং তা সরিয়ে ফেলা হয়।

ব্যক্তিগত সচেতনতার প্রয়োজন

প্রযুক্তি এবং প্রশাসনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সচেতনতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক মানুষ না বুঝেই বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করে, যা গুজব ছড়ানোর অন্যতম কারণ। মানুষকে বুঝতে হবে, কোনো তথ্য শেয়ার করার আগে সেটির সত্যতা যাচাই করা অপরিহার্য।

বিশেষ করে যারা সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয়, তাদের দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ভিডিও বা ছবি শেয়ার করার আগে উৎস যাচাই করা এবং প্রমাণিত সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা উচিত।

প্রশাসনিক উদ্যোগ

গুজব রোধে সরকার ও প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের সরকার ইতিমধ্যে কিছু আইন প্রণয়ন করেছে যা অনলাইনে ভুল তথ্য ছড়ানো বন্ধ করতে সহায়ক হতে পারে।

“সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট” এর আওতায় গুজব বা ভুল তথ্য ছড়ানোর শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এই আইনকে সংশোধন করে প্রয়োগ আরো শক্তিশালী করতে হবে এবং জনগণের মধ্যে এ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

মিডিয়ার দায়িত্ব

গুজব রোধে গণমাধ্যমেরও একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। সংবাদ মাধ্যমকে আরো সতর্ক থাকতে হবে যাতে তারা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ না করে। একই সাথে, দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা ও ফ্যাক্ট-চেকিং রিপোর্টিংকে উৎসাহিত করতে হবে।

গণমাধ্যমের একটি বড় দায়িত্ব হলো সমাজের মাঝে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেয়া এবং গুজব প্রতিরোধে অবদান রাখা।

শিক্ষার মাধ্যমে সমাধান

শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়েও গুজব প্রতিরোধ করা সম্ভব। শিক্ষার্থীদেরকে স্কুল এবং কলেজ পর্যায় থেকেই গুজব ও ভুল তথ্য চিহ্নিত করার পদ্ধতি শেখানো উচিত। এ ধরনের শিক্ষা তাদের ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। গণমাধ্যম সাক্ষরতা শিক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে সমাজে সচেতনতা তৈরি করা সম্ভব।

সর্বোপরি গুজব রোধের দায়িত্ব শুধুমাত্র প্রশাসন বা প্রযুক্তির নয়। এটি একটি সমন্বিত উদ্যোগের ফলাফল হতে হবে যেখানে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং সরকার সবাই একসাথে কাজ করবে। বাংলাদেশে গুজবের ক্ষতিকর প্রভাব রোধ করতে হলে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের পাশাপাশি সঠিক আইন প্রয়োগের প্রয়োজন।

লেখক:শিক্ষার্থী; আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।



Source link

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *