অসঙ্গতি ও আইনি কাঠামো বিশ্লেষণ
অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা জনমনে যথেষ্ট আলোচনার সৃষ্টি করেছে। মামলার নথি, ব্যবহৃত আইনি ধারা এবং বাদীর অভিযোগের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অসঙ্গতি ও প্রশ্ন উঠে আসে, যা মামলার যৌক্তিকতা ও আইনি ভিত্তি নিয়ে সন্দেহ তৈরি করে।
প্রথমত, মামলাটি করা হয়েছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭/১১৭(৩) ধারায়, যা মূলত জনশান্তি বিনষ্টের আশঙ্কা প্রতিরোধের জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাদীর লিখিত অভিযোগে এসেছে ব্যবসায় অংশীদার হওয়ার প্রতিশ্রুতি, আর্থিক লেনদেন এবং বিনিয়োগ ফেরত পাওয়া নিয়ে মতবিরোধের কথা যা প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণই দেওয়ানি আইনের আওতাভুক্ত। এখানেই মৌলিক প্রশ্ন দাঁড়ায়: একটি চুক্তিভিত্তিক ও আর্থিক বিরোধকে কেন ফৌজদারি মামলার কাঠামো ব্যবহার করে সমাধানের পথে নেওয়া হলো? দেওয়ানি প্রকৃতির বিরোধে ফৌজদারি আইন প্রয়োগ করার প্রবণতা অনেক সময় অযৌক্তিক চাপ সৃষ্টি বা ব্যক্তিকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে অপব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আর্থিক প্রমাণের ঘাটতি। বাদী দাবি করেছেন, তিনি মোট ২৭ লাখ টাকা হস্তান্তর করেছেন, কিন্তু কোনো চুক্তিপত্র, সমঝোতা স্মারক, রশিদ, ব্যাংক ট্রানজেকশন বা বিনিয়োগের শর্তাবলি উপস্থাপন করতে পারেননি। ফৌজদারি মামলায় অভিযোগকে প্রমাণযোগ্য করে তোলার জন্য নথিপত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও এই মামলায় তা একেবারেই অনুপস্থিত। প্রমাণহীন অর্থগত দাবি অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা দুর্বল করে দেয় এবং আইনি মূল্যায়নে স্বচ্ছতা কমিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন : Can a Witness Be Convicted? A Clash Between Domestic and ICC Principles
একইভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগও প্রশ্নবিদ্ধ। সাধারণত কেউ হুমকি পেলে সঙ্গে সঙ্গে থানায় জিডি করা, মৌখিক অভিযোগ জানানো বা ৯৯৯–এ ফোন করা স্বাভাবিক। কিন্তু এই মামলায় অভিযোগ এসেছে দীর্ঘ সময় পরে, এবং সেখানে কোনো স্বাধীন সাক্ষ্য বা পরিস্থিতিগত প্রমাণও নেই যা ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মানদণ্ড পূরণ করে না এবং অভিযোগের উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন প্রশ্ন তোলে।
মেহজাবীনের অনুপস্থিতির কারণে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও তিনি আত্মসমর্পণ করে জামিন নিয়েছেন যা দেখায় তিনি আইন এড়ানোর চেষ্টা করছেন না বরং আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণে আগ্রহী। পরবর্তীতে তিনি লিখিত জবাব দেওয়ার সম্পূর্ণ সুযোগ পাবেন। তবে মামলার সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সোশ্যাল মিডিয়ায় যা ঘটেছে সেটি আরেকটি ঝুঁকি তৈরি করেছে। দ্রুত ও অতিরঞ্জিত প্রচার অনেক সময় বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে “মিডিয়া ট্রায়াল”–এর পরিবেশ তৈরি করে, যা ন্যায়বিচারের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
এই মামলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো জনপ্রিয় ব্যক্তিকে ঘিরে সুবিধাবাদী প্রবণতার বিষয়টি। দেশ-বিদেশে বহুবার দেখা গেছে তারকা, সফল ব্যক্তি বা আলোচিত পাবলিক ফিগারদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা করা হয় ঈর্ষা, প্রতিহিংসা, ব্যক্তিগত স্বার্থ কিংবা আলোচনায় আসার আকাঙ্ক্ষা থেকে। মেহজাবীনের মন্তব্য যে মামলাটি ‘সাজানো’, তা এই সন্দেহকে আরও প্রবল করে যে এই অভিযোগ হয়তো প্রকৃত আর্থিক বিরোধ নয় বরং ব্যক্তিকে অযথা সামাজিক, পেশাগত বা মানসিক চাপে ফেলার প্রচেষ্টা হতে পারে।
সব মিলিয়ে দেখা যায়, এই মামলার ধারার ব্যবহার, অভিযোগের প্রকৃতি, প্রমাণের অভাব এবং অভিযোগ উত্থাপনে অস্বাভাবিক বিলম্ব সবকিছুই মামলার যৌক্তিকতা পুনর্বিবেচনার দাবি তোলে। আইনের মূল উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, কোনো ব্যক্তিকে হেয় করা নয়। দেওয়ানি ধরনের একটি বিরোধকে ফৌজদারির কাঠামোয় এনে ফেলা আইন প্রয়োগের সঠিক উদাহরণ নয়; বরং তা আইনের অপব্যবহারের ঝুঁকি তৈরি করে এবং বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
Leave a Reply